প্রয়োজনে সম্পদ বেচে বিমা দাবি পরিশোধ করার সুপারিশ অংশীজনদের
বিমা খাতের উন্নয়ন এবং গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য বিমা দাবি পরিশোধকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন অংশীজনরা।
প্রয়োজনে বিমা কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকদের দাবির অর্থ পরিশোধের সুপারিশ করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সঙ্গে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) নির্বাহীদের এক সভায় এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
আইডিআরএ তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের সেপ্টম্বর পর্যন্ত বিমা খাতে মোট দাবির পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে দাবি পরিশোধ হয়েছে ২ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা, যা মোট দাবির ২৮ শতাংশ।
এই সময়ে জীবন বিমার মোট দাবির পরিমাণ ৫ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিশোধ হয়েছে ২ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রায় ৬২ শতাংশ দাবি পরিশোধ হয়নি।
আবার নন-লাইফ বিমার মোট দাবির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিশোধ হয়েছে ৩১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৯০ শতাংশ দাবি পরিশোধ হয়নি।
এই সময়ে বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ১.৫৪ শতাংশ, ফারইস্ট লাইফ ১.৪৯ শতাংশ, গোল্ডেন লাইফ ২.১৮ শতাংশ, পদ্মা লাইফ ০.৮১ শতাংশ, প্রগ্রেসিভ লাইফ ৪.৭০ শতাংশ ও সান ফ্লাওয়ার লাইফ ১.১৯ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেছে।
এই সময়ে আলফা ইসলামি লাইফ ইনস্যুরেন্স, লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশন, মার্কেন্টাইল ইসলামি লাইফ, পপুলার লাইফ, রূপালী লাইফ, সোনালী লাইফ, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স প্রায় শতভাগ বিমা দাবি পরিশোধ করেছে।
সভায় আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম আসলাম আলম বলেন, 'বর্তমানে বিমা খাত এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।'
তিনি বিশেষভাবে জীবন বিমা খাতে দাবি পরিশোধের দুরবস্থা, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি ল্যাপসের উচ্চ হার, এবং জীবন ও সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগের জটিলতা তুলে ধরেন।
আসলাম আলম বলেন, বিমা খাতের উন্নয়নের প্রথম ধাপ হলো প্রতিটি কোম্পানিকে তাদের নিজস্ব সমস্যা চিহ্নিত করা, সমস্যাগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনা এবং সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিমা কোম্পানি এবং বিমাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য দপ্তরের অভ্যন্তরীণ সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, বিমাসংশ্লিষ্ট আইনের সীমাবদ্ধতা ও সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করা সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে বিআইএ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
বিআইএর প্রেসিডেন্ট নাসির উদ্দিন আহমেদ আইডিআরএ চেয়ারম্যানের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন এবং নির্বাহী কমিটির সদস্যদের পর্যায়ক্রমে তাদের মতামত প্রকাশ করার অনুরোধ জানান।
বিআইএর নির্বাহী কমিটির সদস্য বেলাল আহমেদ বিমা খাতে দ্রুত সংস্কার করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। 'খাতটির অভিভাবক হিসেবে কর্তৃপক্ষের উচিত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে আরও কঠোর হওয়া।'
গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সিইও ফারজানা চৌধুরী বলেন, নন-লাইফ বিমা খাতে অতিরিক্ত কমিশন প্রদান এবং বাকিতে ব্যবসা করার প্রবণতা বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করছে।
তিনি মেরিন, মোটর ও অগ্নিবিমার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নন-লাইফ খাতে উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সিইও এম জে আজিম বলেন, কর্তৃপক্ষকে তিন বছরের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে জরুরি বিষয়গুলো চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং ধাপে ধাপে অন্যান্য পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে।
তিনি পরামর্শ দেন, বিমা দাবি পরিশোধ নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে হলেও দাবি পরিশোধের ব্যবস্থা করা জরুরি। যেসব কোম্পানি দাবি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের ব্যবস্থাপনা ব্যয় (যেমন সম্মেলন, বিদেশ ভ্রমণ) কমাতে হবে।
তিনি এজেন্ট লাইসেন্স প্রক্রিয়ার জটিলতা দূর করার এবং এ-সংক্রান্ত ফি কমানোর প্রস্তাব করেন। এছাড়া ইউএমপি সিস্টেমের বিভিন্ন সমস্যাও তুলে ধরেন তিনি।
এশিয়া ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সিইও ইমাম শাহীন বিমা খাতের প্রধান সমস্যা হিসেবে কমিশনকে চিহ্নিত করেন। তিনি বলেন, 'কমিশন কমানো বা বন্ধ করা হলে কিছু কোম্পানি টিকে থাকতে পারবে, তবে অধিকাংশের জন্য টিকে থাকা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।'
তিনি আরও বলেন, নন-লাইফ বিমা খাতে দাবি পরিশোধ বাধ্যতামূলক না হওয়ায় তুলনামূলকভাবে সমস্যার মাত্রা কম।
'তবে বিমা কর্পোরেশন আইনে পুনঃবীমার একচেটিয়া অধিকার সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে দেওয়া হয়েছে, যা বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলোর জন্য গুরুতর সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।'
পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সিইও বিএম ইউসুফ আলী বিমা কোম্পানির পদ-পদবি ও কমিশন-সংক্রান্ত সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, 'কর্তৃপক্ষের সার্কুলার অনুসরণে বিমা কোম্পানিগুলোতে অসংগতি দেখা যাচ্ছে। বেশি কমিশনের আশায় বিমা এজেন্টরা পলিসি এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানিতে স্থানান্তর করছে, যা গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করছে।'
এ সমস্যার জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের দায়ী করা হলেও বিএম ইউসুফ কর্পোরেট সুশাসনের অভাবের দিকেও ইঙ্গিত করেন।
বিআইএর নির্বাহী কমিটির সদস্য সৈয়দ বজলুল আলম বিমা খাতের শোচনীয় অবস্থার কথা উল্লেখ করে 'অ্যাকচ্যুয়ারি'র সমস্যা সমাধান ও কমিশন বন্ধের প্রস্তাব দেন। অন্যথায় অনেক কোম্পানি ঝরে যেতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেন।
বিআইএর ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সিটি জেনারেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান হোসাইন আখতার সভায় আলোচিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে আইডিআরএর জন্য উপযুক্ত রোডম্যাপ প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে পালনের আহ্বান জানান।
তিনি বিমা কোম্পানির আয়ের একটি অংশ পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে ব্যবহারের প্রস্তাব দেন।
বিআইএ প্রেসিডেন্ট নাসির উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশে থার্ড পার্টি বিমা ফের চালু করার এবং বিমা পরিকল্পনা যথাযথভাবে অ্যাকচ্যুয়ারি দ্বারা মূল্যায়নের প্রস্তাব দেন।
তিনি কমিশন সম্পূর্ণ বন্ধ না করে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখার সুপারিশ করেন এবং ব্যাংকাসুরেন্স গাইডলাইনের সীমা খোলার পরামর্শ দেন।
ইন্টল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান অভ্যন্তরীণ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন এবং যানবাহনের জন্য নন-কমপ্রিহেনসিভ ও থার্ড পার্টি বিমার সমন্বয়ে একটি নতুন পলিসি চালুর প্রস্তাব করেন।
তিনি ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়ায় সব বিমা প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বানও জানান।