টিসিবি’র ট্রাকে করে পণ্য বিক্রয় কর্মসূচিতে আসলে কী ঘটছে?
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)- এর ট্রাকে করে ভর্তুকি দেওয়া পণ্য বিক্রির নির্ধারিত শিডিউল শেষ হয়েছে।
তবে মূল্যস্ফীতির এই বাজারে বাড়তি আর্থিক চাপ সামলাতে না পেরে অনেক সুবিধাভোগী আবারও টিসিবির ট্রাক সেল কর্মসূচি চালুর দাবি জানিয়েছেন।
সরকারি এই সংস্থা এর সুবিধাভোগী কার্ডধারী লোকেদের জন্য দেশজুড়ে সারাবছর ভর্তুকি মূল্যে তেল, ডাল ও চাল বিক্রি করে থাকে।
যদিও ট্রাকে করে বিক্রি অস্থায়ী একটি উদ্যাগ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা, যা মূলত লক্ষ্যমাত্রা পূরণের উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে।
জানা যায়, গত বছর ২৪ অক্টোবর ট্রাকে করে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রির কর্মসূচি হাতে নেয় টিসিবি। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড না থাকলেও প্রতিদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামের ২৮ হাজার মানুষ ভর্তুকি মূল্যে ট্রাক সেল থেকে এসব পণ্য কেনার সুযোগ পেতেন।
শুরুতে এ কার্যক্রম ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত চালু থাকার কথা থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে হিসেবে জানুয়ারি থেকে বন্ধ হয়ে যায় ট্রাক সেল কার্যক্রম।
তবে এতে জুলাই অভ্যুত্থানের পরে গঠিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটি সহ সুশীল সমাজের সদস্য এবং সংগঠনগুলো প্রতিক্রিয়া জানালেও টিসিবি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই ৩১ ডিসেম্বর থেকে ট্রাক সেল বন্ধ হয়েছে।
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির টিবিএসকে বলেন, "ফ্যামিলি কার্ডধারী যারা রয়েছেন, তারা কিন্তু সারাবছর পণ্য পান। এর বাইরে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিশেষ সময়ে ট্রাক সেল কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, যেন সাধারণ মানুষ ভর্তুকি মূল্যে পণ্য কিনতে পারেন।"
তিনি বলেন, "ট্রাক সেল কার্যক্রম কিন্তু সারাবছর চালানো হয় না। যখন মূল্যস্ফীতি বেশি থাকে বা কোনো পণ্যের বিশেষ চাহিদা থাকে, তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় টিসিবি ট্রাক সেল কার্যক্রম পরিচালনা করে। তার অংশ হিসেবে অক্টোবরে ২৮ হাজার পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নভেম্বর পর্যন্ত এটা চলমান থাকার কথা থাকলেও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় তা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।"
প্রয়োজন অনুসারে ট্রাক সেল পরিচালনা করা হয় জানিয়ে তিনি আরও বলেন, "বাজারে চাহিদা বেশি থাকলে, তখন টিসিবি ট্রাক সেল পরিচালনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। যেমন— রমজানে ছোলা ও খেজুর বিক্রি করা হয়। গত নভেম্বরে আলুর বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে আলু বিক্রি করেছিল টিসিবি।"
টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকা মহানগরীতে ৫০টি ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২০টি ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে তেল, ডাল ও চাল বিক্রির কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল টিসিবি। এই কার্যক্রমের আওতায়, একজন ভোক্তা সর্বোচ্চ ২ লিটার ভোজ্যতেল প্রতিলিটার ১০০ টাকায়, ২ কেজি মসুর ডাল প্রতিকেজি ৬০ টাকায় এবং ৫ কেজি চাল প্রতিকেজি ৩০ টাকায় কিনতে পারতেন।
এদিকে জানুয়ারি মাস থেকে শুধু স্মার্টকার্ডধারী পরিবারকেই পণ্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে টিসিবি। এক্ষেত্রে এক কোটি কার্ডধারী পরিবারের মধ্যে শুধুমাত্র ৫৭ লাখ স্মার্ট কার্ডধারী এ সুবিধা পাবেন।
টিসিবির পণ্য কেনার জন্য একটি পরিবারকে এতদিন একটি সাধারণ কাগুজে কার্ড দেওয়া হতো। পুরনো এই কার্ড বাতিল করে এখন স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে পণ্য বিতরণ শুরু করেছে টিসিবি।
এ বিষয়ে টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ূন কবির জানান, "এক কোটি হাতে লেখা কার্ড যখন এনআইডি'র সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন করা হয়েছে— তখন দেখা গেছে, একই এনআইডি দিয়ে ঢাকায় একবার কার্ড নিয়েছে, আবার নিজের গ্রামের বাড়িতে হয়তো আরেকটা কার্ড করেছে। যার ফলে যখন আমরা এনআআইডি দিয়ে যাচাই করতে গেলাম, তখন ৪৩ লাখ কার্ড বাদ পড়ে গেছে।"
"স্মার্ট কার্ড করার বিষয়টি চলমান প্রক্রিয়া ছিল। আমরা স্বচ্ছতার জন্য স্মার্টকার্ড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যখন সার্ভারে তাদের তথ্য দেওয়া হয়েছে, অটোমেটিক এসব কার্ড বাতিল হয়ে গেছে," বলেন তিনি।
স্মার্ট কার্ড দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, "নতুন ছয় লাখ স্মার্টকার্ড তৈরির (প্রিন্ট) কাজ চলছে। এ ছয় লাখের মধ্যে যারা মোবাইল নাম্বার বা অন্য কোনো ভুলে বাদ পড়েছেন, তারা যুক্ত হয়েছেন। এছাড়া নতুনরাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। স্মার্টকার্ড তৈরির জন্য আরও ১৩ লাখ পরিবারের তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। ২-১ মাসের মধ্যে তারাও স্মার্ট কার্ড পেয়ে যাবেন।"
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন টিবিএসকে বলেন, "আগে ১ কোটি কার্ডধারী পরিবারকে টিসিবি পণ্য দিত, এখন দিচ্ছে মাত্র ৫.৭ লাখ পরিবারকে; এরমধ্যে ৪৩ লাখ পরিবার বাদ পড়েছে। অনেকে যারা বাদ পড়েছেন, তাদেরকে ভুলবশত বাদ দেওয়া হতে পারে।"
তিনি বলেন, ট্রাক সেল কার্যক্রম হঠাৎ বন্ধ না করে আরও কয়েকদিন চলতে পারত।
"এরই মধ্যে, সরকার বিভিন্ন পণ্যের উপর ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়িয়েছে। তাই এমন প্রশ্ন আসা খুব স্বাভাবিক যে, সরকারের উদ্দেশ্য কি জনগণের সমস্যা সমাধান করা, নাকি আরও সমস্যা তৈরি করা?," বলেন তিনি।
গতকাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত মতামত অংশে সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান লেখেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত, যেমন— কর বৃদ্ধি এবং টিসিবি ট্রাক সেল কর্মসূচি স্থগিত করা ইত্যাদি বিষয়গুলো স্পষ্টতই রাষ্ট্রীয় নীতির অদূরদর্শীতা এবং অসঙ্গতি প্রকাশ করে।
"শতাধিক পণ্যের উপর কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত জনসাধারণের জন্য সত্যিই উদ্বেগজনক। বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ ইতোমধ্যেই বাড়তি চাপের মধ্যে আছে, এ অবস্থায় কর বাড়লে তা আরও আর্থিক বোঝা তৈরি করবে। এতে বাজারে পণ্যের দাম বাড়বে— দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের জন্য পরিস্থিতি আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে," যোগ করেন তিনি।
তিনি জানান, "অন্যদিকে, টিসিবির ট্রাক সেল কর্মসূচি স্থগিত করাও উদ্বেগজনক। কারণ এটি নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য ভর্তুকি মূল্যে পণ্য পাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। মুদ্রাস্ফীতির তীব্রতা এবং জনগণের আয়ের অস্থিতিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে, এই কর্মসূচি আরও সময় ধরে চলতে পারত।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান আরও উল্লেখ করেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত অনেকটা বাস্তবতার বিপরীতে চলে গেছে। টিসিবির ট্রাক সেল কর্মসূচি স্থগিত করে, সরকার দেশের অর্থনৈতিক নীতি ও জনসাধারণের চাহিদার মধ্যে যে সংযোগ, সেটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। ফলে দরিদ্রদের চাহিদা মেটানোর সুযোগ কমে গেল। আর এতে কেবল দরিদ্রদের জীবনযাত্রারই খারাপ হবে না, বরং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থাও ক্ষুন্ন হবে।