জড়োয়া সেট, সীতাহার, টায়রা নাকি টিকলি? যা চান, সবই পাবেন সাভারের এ গ্রামে
বাংলাদেশে ৮৭ হাজারেরও বেশি গ্রাম রয়েছে। এরমধ্যে ফুলের গ্রাম, আমের গ্রাম, লিচুর গ্রামের নাম তো অনেক শুনেছেন। কখনো গয়না গ্রামের নাম শুনেছেন কী? যে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পরম যত্ন নিয়ে গয়না গড়ে; গয়না-ই তাদের ধ্যান-জ্ঞান-নেশা ও পেশা।
না, চাঁদের বুড়ির গল্প একেবারেই নয়। এমন গ্রাম সত্যিই আছে। সে গ্রামের নাম ভাকুর্তা। যদিও গয়না গ্রাম বলেই মানুষের কাছে গ্রামটি বেশি পরিচিত।
কুয়াশামাখা প্রচণ্ড শীতের সকালে যখন গয়না গ্রামে পৌঁছালাম, তখনও সূর্য্যি মামা উঁকি দেয়নি আকাশে। সবুজের সমারোহের মাঝে একটা ছোট্ট গ্রাম। ক্ষেতজুড়ে মটর শাক আর সরিষা। বিস্তৃত মাঠ ছেয়ে গেছে সর্ষে ফুলে। জাঁকিয়ে বসা শীতে গয়নার কারিগরেরাও এত সকাল সকাল গয়না তৈরির কাজ পুরোদমে শুরু করেননি।
ভাকুর্তা বাজার পার হয়ে বটতলা। বটতলার আশেপাশে জনবসতি। কোনোটা টিনের বাড়ি, কোনোটা পাকা। দুই-একটা যে সুরম্য দালান নেই তাও নয়। এরকম ছোটো বড় কাঁচা-পাকা সব বাড়িতেই কম বেশি গয়না গড়ানোর কাজ হয়।
জড়োয়ার সেট, সীতাহার, নাকছাবি, গোলাপবালা— কী চাই আপনার? নূপুর, টায়রা কিংবা টিকলি? হ্যাঁ, তাও আছে। একেক গয়নার একেকরকম নকশা। আবার একই নকশার নেকলেস, কানের দুল, চুড়ি দিয়ে একটা পুরো সেটও পাবেন।
আমাদের পরিচিত প্রতিবেশী, বান্ধবীর দল থেকে শুরু করে নারীমহলে গয়না পরতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুব কম। কেউ হয়তো বেশি নকশার সাবেকী গয়না পছন্দ করেন, কেউবা আধুনিক। একেবারেই গয়না ভালোবাসেন না এমন নারীও সারাজীবনে কখনো না কখনো গয়নায় সাজিয়ে তুলেছেন নিজেকে। তা যে নারীর গয়না নিয়ে এক ধরনের প্যাশন আছে, সেই নারী গয়নার কাজ ভালো করবেন– এ তো স্বাভাবিক ঘটনা। যদিও আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষরা এ কাজের সাথে বেশি যুক্ত। কিন্তু গয়না গ্রাম একেবারেই তার ব্যতিক্রম। এই গ্রামের মেয়েরা শুধু গয়না পরতে নয়, গড়তেও জানে।
গয়নার অন্তরালে থাকা মানুষেরা
শিউলি রানী দাস তখন কেবল ভাতের হাড়ি চড়িয়ে গয়নার কাজ নিয়ে বসেছেন। এক চিলতে দাওয়ায় খেলে বেড়াচ্ছে ছেলেমেয়ের দল। জানলার ধারটাতে আলোর দিকে মুখ করে এক মনে কাজ করে চলেছেন তিনি। দেখে মনে হচ্ছে যেন ডালে নুন চেখে দেখার মতনই সোজা কোনো কাজ।
বেশিদিন নয়, ৪/৫ বছর যাবত গয়না গড়ানোর কাজ করছেন শিউলি রানী। সংসারের নিত্য কাজের পাশাপাশি অর্ডার নিয়ে গয়না গড়েন তিনি। সীতাহার এক ডজন, নূপুর ৩ জোড়া- এমন সব অর্ডার। বিয়ের মৌসুমে অর্ডার বেশি থাকে, তাই চাপ সামলাতে একটু হিমশিম খেতে হয়। সারাবছর এতটাও ব্যস্ততা থাকে না।
ছোটোবেলা থেকেই গয়নার প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ কাজ করত শিউলির। মেলা বসলেই বাবার কাছে মাটির গয়না কিনে দেওয়ার আবদার জুড়ে বসতেন তিনি। এরপর ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী স্বর্ণকার হওয়ার সুবাদে গয়না তৈরি দেখতে পেতেন ঘরের দোরেই। এরপর আস্তে আস্তে তার স্বামী সোনার কারবার ছেড়ে রূপার কারবার শুরু করলেন। সেই সময় থেকেই টুকটাক করে কাজ শিখেছেন স্বামীর কাছে। সেলাইফোড়াই করতে গিয়ে বালিশের কভারে নকশা তুলেছেন কত...কিন্তু গয়নায় নকশা যে সত্যি কখনো তুলতে পারবেন, তা ভাবেননি।
এভাবেই শখ করে গয়না গড়বার তালিম নেয়া। বছর পাঁচেক আগে সংসারে আর্থিক দুর্গতি দূর করতে তিনি তামা-পিতল দিয়ে গয়না গড়ার কাজ করা শুরু করলেন। মহাজনের থেকে কাঁচামাল এনে ঘরে বসে নকশা তোলা, তামা পিটিয়ে সাধের কানের ঝুমকো, নতুন গয়না গড়াতে পারলে মনে আনন্দ তো হয় ই— সাথে আসে টাকা। ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচটা যেন বেধে না থাকে।
ঢাকার দামি দামি শপিং মল, মফস্বলের নকল গয়নার দোকান, নিউমার্কেট বা চাদনীচকের মতোন মার্কেট থেকে আপনি কোনো উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে অথবা কোনো উপলক্ষ ছাড়াই যেসব গয়না কেনেন— তার সবই আসে এই অখ্যাত গ্রাম ভাকুর্তার নাম না জানা কারিগরদের হাত ধরে। কারিগরদের নাম যেমনি অজানা, তেমনি তাদের বিচিত্র গল্পও অশ্রুতই বটে। নতুন কনের গায়ের ঝলমলে গয়না আর উৎসবের রোশনাইয়ের ভিড়ে চাপা পড়ে যায় এসব প্রান্তিক মানুষের গল্প।
সালটা ১৯৯০। তাঁতিবাজারে মামার দোকানে গয়না তৈরির কাজ শেখা শুরু করেন শিউলির স্বামী কালাচাঁদ দাস। স্বর্ণকারের পেশাটা অবশ্য তার প্রজন্মের নয়, বাপ-দাদার আমল থেকেই এই ধারা চলে আসছে। সে সময়ে সোনার ভরি ছিল ৫,৬০০ টাকা। বছর দশেকের মধ্যেই সোনার দাম বেড়ে যেতে শুরু করে। দাম বাড়ায় আস্তে আস্তে সোনার গয়না কেনার প্রবণতা কমতে শুরু করে। এরকমই এক সময়ে এসে ২০০২ সালে তিনি রূপার গয়না গড়াতে শুরু করলেন।
তাঁতিবাজারে মামার দোকানের অর্ডারের কাজ করেন তিনি, নিজস্ব কারবার নেই তার। গয়না হিসাবে পান টাকা। এই কাজে যত পরিশ্রম, তত টাকা। একদিন বসে থাকলে, শরীরটা বিগড়োলে টাকা নেই। বলতে গেলে অনেকটা দিনমজুরি কাজ— জানাচ্ছিলেন কালাচাঁদ।
ভাকুর্তা বাজার: গয়নার হাট
বেলা একটু চড়তেই ভাকুর্তা বাজারের দোকানগুলো খুলতে শুরু করলো। মাঝখানে রাস্তা। রাস্তার দুপাশ জুড়ে খান ত্রিশেক দোকান। সব দোকানেরই মোটামুটি একই দৃশ্য। তাকে তাকে, টেবিলে, মেঝেতে গয়নার পর গয়না বিছানো। তবে আশ্চর্যের বিষয়, গয়নার রঙ খানিকটা কালচে। আমরা দোকান থেকে যেমন ঝকঝকে তকতকে উজ্জ্বল রঙের গয়না কিনি তেমনটা নয়।
সরকার জুয়েলার্স নামের একখানা দোকানে ঢুকে দেখা গেল, দোকানি গয়না গোনা-বাছায় বেশ ব্যস্ত। নিচে বসে আরেকজন গয়না গুনে প্যাকিং এর কাজ করছে। তবে কী এই কালো রঙা গয়না অন্য কোথাও যায় রঙ করবার জন্যে?
দোকানী সুজন সরকারের সাথে কথা বলে জানা গেল, এই সমস্ত গয়না এমনভাবেই কিনে নিয়ে যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার গয়না ব্যবসায়ীরা। পরে তারা নিজেদের মতোন করে রঙ করে বিক্রি করেন। একই নকশার গয়না সোনালি কিংবা রূপালি রঙ দেওয়ার কারণে অন্যরকম দেখতে মনে হয়।
কত বছর ধরে গয়নার কারবারের সাথে যুক্ত জিজ্ঞেস করায় কী যেন হিসেব করে ক্যালকুলেটর চাপতে দেখা গেল দোকানিকে। ভাবলাম গয়নার হিসাব করছেন হয়তো। পরক্ষণেই ভুল ভাঙল দোকানির জবাবে। তিনি ক্যালকুলেটরের ডিসপ্লে থেকে চোখ সরিয়ে জানালেন, ৪১ বছর ধরে গয়নার ব্যবসার সাথে যুক্ত।
প্রথমদিকে নিজেও গয়না বানিয়েছেন প্রচুর। এখন নিজে হাতে কাজ করা হয় না বহুদিন। অর্ডার দিয়ে গয়না বানিয়ে নেন। চুক্তিভিত্তিক কাজের মাধ্যমে কারিগররা নির্দিষ্ট অর্থ পান পাশাপাশি সময়মাফিক অর্ডার সাপ্লাই দেওয়া যায়। প্রতি পিস গয়না ১১০ টাকা থেকে শুরু করে ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তিনি মূলত পাইকারি হিসাবে বিক্রি করেন গয়না। তবে অনলাইনে অর্ডার নেন না। তাই গ্রামে এসেই কিনতে হয় ব্যবসায়ীদেরকে।
দিনটি ছিল শুক্রবার। তাই বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীদের নিত্য কেনাবেচার দৃশ্যটা চোখে পড়লো না।
ভাকুর্তা গ্রামে গয়না তৈরির প্রচলনটা আজকালের নয়, তিনশ বছর ধরে এ গ্রামের মানুষ গয়না গড়ায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গয়নার সাথে তাদের মিতালি। শুধু মিতালি অবশ্য নয়, রুটি-রুজিও। গয়নার প্রতি ভালোবাসা ওদের রক্তে মিশে আছে। ব্রিটিশ আমল থেকে এই গ্রামের মানুষ বিকল্প পেশা হিসেবে গয়না গড়ার কাজ শুরু করেন। তবে প্রধান পেশা তখনও ছিল কৃষিকাজ। এখন অবশ্য গয়না গড়ানোটাই মূল পেশা।
গয়না গ্রামে বাড়ির দাওয়ায় দাওয়ায় আগুনের ফুলকি মানেই গয়না গড়ার ধুম পড়ে যাওয়া। ছেলে থেকে বুড়ো সবাই তখন গয়না গড়ার নেশায় মাতে। নেশা ই বটে। যেন একটা ঘোর। এভাবে দেশীয় গয়না শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে ভাকুর্তা জনপদের অতি সাধারণ মানুষ।
যেভাবে যাবেন
গয়না গ্রামে পৌঁছাতে হলে প্রথমে আপনাকে ঢাকা শহরের গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ধরে যেতে হবে আমিনবাজার। আমিনবাজার থেকে প্রাইভেট গাড়ি কিংবা রিক্সায় করে ৫-৬ কিলোমিটার গেলেই ভাকুর্তা গ্রাম।
গাবতলী থেকে ভাকুর্তার দূরত্ব খুব বেশি নয়। গাবতলীর কাছাকাছি হলেও ভাকুর্তা গ্রাম সাভার উপজেলার মধ্যে পড়ে। গাবতলী থেকে গয়নার গ্রাম পৌঁছাতে আপনার খরচ পড়তে পারে সর্বোচ্চ ৬০-৭০ টাকা।
যেমন করে তৈরি হয়
ভাকুর্তা বাজারের ভেতরের একটি দোকানে মোমকাঠে বসানো গয়না ব্রাশ করছিলেন মাসুদ হাসান। বছর সাতেক ধরে এ দোকানে কাজ করেন তিনি। তার সাথে কথা বলে জানা গেল, ঠিক কোন প্রকিয়ায় গয়নাগুলো গড়া হয়।
মূলত তামা আর পিতল মিশ্রিত শংকর ধাতু দিয়ে গয়না গ্রামের নকল গয়নাগুলো তৈরি হয়। গয়না তৈরির এই কাঁচামাল আসে ভারত এবং চীন থেকে। গয়না গড়ার একেবারে প্রথম ধাপে তামা-পিতল মিশ্রিত ধাতুকে গলিয়ে তরল করে নেওয়া হয়। এরপর এই তরল পদার্থ ফেলা হয় নকশা খচিত মোম কাঠের ছাঁচে। এখানেই গয়না বাহারি নকশায় সেজে ওঠে।
যত নকশার বৈচিত্র্য, তত গয়নার অনন্য প্রকাশ। তা মোম কাঠের ছাঁচে ধাতু মোটামুটি কিছুটা জমে গেলে ছাঁচসহ গয়নার নকশার অংশ সুন্দর করে ব্রাশ করে নেওয়া হয়। এতে করে নকশার ওপর ময়লার প্রলেপ জমতে পারে না।
এরপর হালকা আঁচে তাপ দিয়ে ছাঁচ ভেঙে ফেলা হয়। ছাঁচ ভেঙে ফেললেই বেরিয়ে আসে একখানা আস্ত গয়না— এই ধরুন মানতাশা কিংবা চূড়, যা আপনি চান তাই। আগে চিকন পাইপের মাধ্যমে ফুঁ দিয়ে দিয়ে গহনা তৈরির কাজ করা হতো। আজকাল সেই কাজ করা হয় গ্যাস দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে।
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া সবখানেই গয়নার চল সমানতালে আছে। যাদের সাধ্য আছে তারা পরেন সোনা কিংবা রূপার গয়না, কিন্তু যাদের সাধ্য নেই তাদের ভরসা এই তামা পিতলের নকল গয়নাই।
ঝুটা গয়নার দৌলতে যে হাসি ফোটে নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের কোনো গৃহিণীর মুখে, সে হাসি কিন্তু ঝুটা নয়— একেবারে নিখাদ। আর এই নির্ভেজাল হাসি ফোটানোর কাজে নিরলস পরিশ্রম করে চলেন যেসব কারিগরেরা, তারা থেকে যান অন্তরালে।
হয়তো খানিক বিনিময় মূল্য চোকান মহাজন, কিন্তু শিল্পীর কদর কী তারা সত্যিই পান? গয়নার চাকচিক্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় এই শিল্পীদের কথা। তবু বেঁচে থাক গয়না শিল্প কারো সাধ আহ্লাদ আর কারো খাবার যোগানোর খোরাক হয়ে।
ছবি: অনুস্কা ব্যানার্জী/টিবিএস