সংশোধিত এডিপির বরাদ্দ কমছে ৪৯,০০০ কোটি টাকা
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অস্থিরতা ও প্রকল্প সংশোধনের কারণে তা ধীরগতিতে বাস্তবায়ন হতে থাকায় সরকার চলতি অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ ৪৯,০০০ কোটি টাকা বা ১৮.৪৯ শতাংশ কমাতে যাচ্ছে।
অর্থ বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এরমধ্যে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ কমছে ৩০,০০০কোটি টাকা বা ১৮ শতাংশ এবং বৈদেশিক তহবিলের বরাদ্দ কমছে ১৯,০০০ কোটি টাকা বা ১৯ শতাংশ।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ অনুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার এ যাবৎকালের সর্বনিম্ন।
নভেম্বর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ১২.২৯ শতাংশ— যা ২০২৪ অর্থবছরে ১৮.৪১ শতাংশ এবং তার আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৭.০৬ শতাংশ।
পরিকল্পনা বিভাগের কার্যক্রম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত মার্চ মাসে সংশোধিত এডিপি অনুমোদন দেওয়া হয়। এবার তা এগিয়ে নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এর অংশ হিসাবে চলতি অর্থবছরে অর্থবিভাগ এডিপির সিলিং নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই নির্ধারিত সিলিংয়ের মধ্যেই বিভিন্ন সেক্টেরে এডিপির বরাদ্দ বণ্টন করবে কার্যক্রম বিভাগ।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভা হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এ তারিখ এগিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও পরিকল্পিনা কমিশনের কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জুলাই পরবর্তী সময়ে সব ক্ষেত্রে অস্থিরতা বিজার করছে। পরিস্থতি স্বাভাবিক না। এ কারণে চলতি অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন হার গত এক দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন।"
তিনি বলেন, "আবার পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তাও বলা যাচ্ছে না। ফলে চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নে খুব বেশি সময় পাওয়া যাবে না।"
"আবার সরকার রাজস্ব আহরণ করে এডিপির বরাদ্দের যোগান দেয়। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতার বাইরে এবার মহার্ঘ ভাতা দেওয়ারও ঘোষণা হয়েছে। ফলে এডিপিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া যাচ্ছে না।"
"বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারের জন্য সরকারি তহবিল থেকে একটা অংশ ব্যয় করতে হয়। এ কারণে বৈদেশিক অর্থায়নও আসছে না। উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড়ও কমে গেছে। তবে বরাদ্দ কমলেও এখনো ২ লাখ কোটি টাকার উপরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দও ব্যয় করা যাবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে," যোগ করেন তিনি।
চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির আকার ২,৬৫,০০০ কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ রয়েছে ১,৬৫,০০০ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ রয়েছে ১,০০,০০০ কোটি টাকা।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপির তুলনায়, সংশোধিত এডিপির (আরএডিপি) আকার কমেছিল ১৮,০০০ কোটি টাকা বা ৬.৮৪ শতাংশ। এডিপির তুলনায় সংশোধিত এডিপিতে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ কমেছে ৭,৫০০ কোটি টাকা বা ৪.৪৪ শতাংশ এবং বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ কমেছে ১০,৫০০ কোটি টাকা বা ১১.১৭ শতাংশ।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, জুলাই অভ্যুত্থান পরিবর্তী সময়ে এডিপি বাস্তবায়ন করা যায়নি। কারণ প্রশাসনের সবক্ষেত্রে অস্থিরতা বিজার করছে— যা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। এ কারণে চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের গতি কম। বাস্তবায়ন কম থাকার কারণে চলতি অর্থবছরে সংশোধিত এডিপিতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর চাহিদাও কমেছে। এরসঙ্গে সরকারের রাজস্ব আহরণ বিবেচনায় এডিপির সিলিং নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, তারচেয়ে বেশি সিলিং দেওয়া হয়েছে সংশোধিত এডিপিতে। সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চাহিদার চেয়ে সংশোধিত এডিপির সিলিং বড় করা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টারা।
এদিকে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, আগের সরকারের সময়ে নেওয়া চলমান সব প্রকল্পই সরকার পর্যালোচনা করেছে। অগুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া অনেক প্রকল্প বা স্কিম বাদ যাচ্ছে। এতে অর্থ ব্যয়ের চাহিদা কমেছে।
আবার জুলাই অভ্যুত্থানের পরে অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক চলে গেছেন। অনেক প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফলে এডিপি বাস্তবায়ন হারও কমে গেছে। অনেক দেশীয় ঠিকাদারও প্রকল্প এলাকায় এখনও ফিরে আসেননি। একইভাবে বৈদেশিক অর্থায়নের অনেক প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার অনুপস্থিত রয়েছেন। এই বাস্তবতায় এডিপিতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে বলে জানান তারা।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাস্তবায়ন গতি কম থাকায় সরকারি তহবিলের চাহিদাও অনেক কমেছে। সাধারণত অন্যান্য অর্থবছরের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সরকারি তহবিল থেকে চাহিদা অনেক বেশি থাকে। কিন্ত চলতি অর্থবছরে এডিপিতে যে পরিমাণ সিলিং বেধে দেওয়া হয়েছে, চাহিদা তারচেয়ে কম রয়েছে। তবে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে চলতি অর্থবছরে চাহিদারে চেয়ে বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলেরা সঙ্গে বৈঠক করে করে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে ৭০,০০০–৭৫,০০০ কোটি টাকা চাহিদা দিয়েছিল। কিন্ত সরকার বৈদেশিক অর্থায়ন ব্যবহারের গুরুত্ব দেওয়ায় বরাদ্দ বাড়িয়ে ৮১,০০০ কোটি টাকার সিলিং দেওয়া হয়।