সাবেক ৫০ নারী এমপিসহ ৩০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে এনবিআর
কর ফাঁকি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের সন্দেহে ৩০০-র বেশি ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নতুন গঠিত আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট (টিআইআইইউ)। এদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ, বিচারক, শিল্পী, সাংবাদিক ও সাবেক আইনপ্রণেতারা রয়েছেন।
ইউনিটের কর্মকর্তাদের মতে, তালিকায় ১২তম জাতীয় সংসদের ৫০ জন সাবেক মহিলা সংসদ সদস্য রয়েছেন। পাশাপাশি ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত ও কথিতভাবে কারচুপি হওয়া নির্বাচনের সাথে যুক্ত প্রায় ১০০ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশ ক্যাডার কর্মকর্তার নাম রয়েছে। গত বছর আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিগত দুই বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
তদন্তের আওতায় রয়েছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী শমী কায়সার এবং ক্রীড়াজগতের ব্যক্তিত্ব শাকিব আল হাসানের মতো তারকারা। এছাড়াও কাস্টমস ও কর ব্যবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগে এনবিআরের নিজস্ব কিছু কর্মকর্তাও সন্দেহভাজনের তালিকায় রয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারাও এই তদন্তে অন্তর্ভুক্ত।
আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট ২০ জন ব্যক্তির বিদেশে, বিশেষত কানাডা ও অন্যান্য দেশে সম্পদের খোঁজ করছে। এনবিআরের একটি দল সম্প্রতি দুবাই সফর করেছে। সেখানে তারা সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কর ফাঁকি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করেছে।
এছাড়াও, ২০টি কোম্পানির বিরুদ্ধে কর সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে তদন্ত চলছে।
আয়কর গোয়েন্দা ইউনিটের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে একটি প্রতিষ্ঠানের বড় ধরনের কর জালিয়াতি উদঘাটন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জালিয়াতির কথা স্বীকার করেছে এবং ইতোমধ্যে কিছু অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে।" তবে, তিনি প্রতিষ্ঠানের নাম এই মুহূর্তে প্রকাশ করতে রাজি হননি।
সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক কর ফাঁকি ও অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে।
আর্থিক অনিয়ম তদন্তের জন্য গঠিত শ্বেত পত্র কমিটির অনুমান অনুযায়ী, এই সময়কালে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে।
আয়কর গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানিয়েছেন, তাদের প্রধান লক্ষ্য আওয়ামী লীগ শাসনামলে কর ফাঁকি বা অবৈধ সম্পদ অর্জনে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা। এরই মধ্যে প্রমাণ সংগ্রহ ও যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ইউনিটের কমিশনার আবদুর রকিব টিবিএসকে বলেন, "আমাদের লক্ষ্য, আর্থিক অনিয়ম প্রকাশ করা এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। অনিয়মের শাস্তি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না এবং সরকার কর পুনরুদ্ধারে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।"
তিনি বলেন, "আমরা স্পষ্ট বার্তা দিতে চাই, যদি কেউ অবৈধ কার্যকলাপে যুক্ত হন, তাকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে।"
সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্সে সেল (সিআইসি) এনবিআরের প্রধান ইউনিট হিসেবে কর, ভ্যাট এবং কাস্টমস ফাঁকি শনাক্তকরণের কাজ করে। এর পাশাপাশি, ভ্যাট ইন্টেলিজেন্স ও কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স এন্ড ইনভেস্টিগেশন ডাইরেক্টরেট (সিআইআইডি) সক্রিয় রয়েছে।
আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট গত কয়েক মাস ধরে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করেছে এবং এটি ঢাকার আগারগাঁওয়ে আলাদা অফিস থেকে পরিচালিত হচ্ছে। ইউনিটের কর্মকর্তারা এআই-ভিত্তিক টুলস ব্যবহার করছেন এবং বিভিন্ন খাত থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে তাদের তদন্তের পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।
সিআইসি যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে তদন্ত করছে, তার বাইরে অন্যান্যদের বিষয়ে তদন্ত করছে আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট।
যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট
এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৫০ জনের বেশি প্রশাসনিক ক্যাডারের কর্মকর্তা, যারা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের বিজয় নিশ্চিত করতে মাঠ ও কেন্দ্রীয় স্তরে কাজ করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্তের আওতায় রয়েছে ৪০ জনের বেশি পুলিশ কর্মকর্তা এবং ৫০ জন সাংবাদিক।
তালিকায় আরও রয়েছেন– আইনজীবী, বিচারক এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সড়ক ও মহাসড়ক, ওয়াসা, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডাব্লিউডি) এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা।
এছাড়া, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, ব্যাংকার, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং আওয়ামী লীগ-এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করা হচ্ছে।
অন্তত ১০ জন সেনা কর্মকর্তা এবং এনবিআরের কাস্টমস ও আয়কর বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার নামও তদন্তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিদের মধ্যে অভিনেত্রী শমী কায়সার, নিপুণ আক্তার, ক্রিকেটার শাকিব আল হাসান এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করা হচ্ছে। সাকিবের মায়ের বিপুল পরিমাণ আয়ের উৎসের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
আয়কর গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেসব ব্যক্তির বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে, তাদের লেনদেনের সঙ্গে আরো অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামও চলে আসতে পারে। ফলে অনুসন্ধানে তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
তদন্ত প্রক্রিয়া যেভাবে চলছে
কর্মকর্তারা জানান, তদন্তের প্রধান উৎস হলো ব্যাংক লেনদেনের তথ্য। এছাড়াও, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তদন্ত চালানো হয়, যেমন সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, ইউটিলিটি সংযোগ সংস্থা (গ্যাস, বিদ্যুৎ), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ এবং সিটি করপোরেশন।
আমদানি-রপ্তানি বা বিদেশি লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ পাচার সম্পর্কেও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। তাছাড়া, বিভিন্ন ব্যবসায় গোপনে বিনিয়োগ করা ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
আয়কর গোয়েন্দা ইউনিটের কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে একাধিক উৎস থেকে অতিরিক্ত তথ্য সংগ্রহ করছেন।
তদন্তে দেশের বিভিন্ন স্থানের ল্যান্ড ডেভেলপারদের কাছ থেকে ক্রেতা এবং প্রকৃত ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য নেওয়া হচ্ছে।
একজন টিআইআইইউ কর্মকর্তার বলেন, "ল্যান্ড ডেভেলপারদের দেওয়া তথ্য আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে তথ্য গোপন করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এখন তাদেরকে সহযোগিতা করতে বাধ্য করা হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা আশা করি আগামী দুই মাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখতে পাবো। এর মধ্যে কিছু কর ফাঁকিবাজ এবং অবৈধ সম্পদধারীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া যাবে।"
ওই কর্মকর্তা বলেন, "অনেক চালাক ব্যক্তি নিজেদের বা পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের নামে ব্যাংক লেনদেন করে না। বরং তারা সম্পত্তির মালিকানা দূর সম্পর্কের আত্মীয় বা তৃতীয় পক্ষের কাছে হস্তান্তর করে, যাতে তাদের সম্পদ লুকানো থাকে।"
অবৈধ সম্পদ শনাক্তকরণের চ্যালেঞ্জ
সাবেক এনবিআর সদস্য সৈয়দ মো. আমিনুল করিম ব্যাখ্যা করেন, যদিও অবৈধ সম্পদ এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত লুকানো সম্ভব, দীর্ঘ সময় ধরে তা গোপন রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, "চিহ্ন সব সময় রয়ে যায় এবং বিস্তারিত তদন্তের মাধ্যমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব সম্পদ উদ্ঘাটিত করা সম্ভব।"
সাবেক সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "অবৈধ লেনদেনে সবসময় একটি ফুটপ্রিন্ট থাকে। যদি যথাযথভাবে তদন্ত করা হয়, তবে ব্যক্তিগত এবং প্রতিষ্ঠানগত জালিয়াতি ও অবৈধ আয় উদঘাটন করা সম্ভব।"
তবে তিনি স্বীকার করেন, বাংলাদেশ অর্থনীতির একটি বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক হওয়ায়, কিছু অনিয়ম উদঘাটনের প্রচুর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সেগুলো শনাক্ত করা সম্ভব নাও হতে পারে।