‘বিকল্প পরিচালক’ নিয়োগে কড়াকড়ি, পদ হারাতে যাচ্ছেন অনেক ব্যাংকের পরিচালক-চেয়ারম্যান
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক ব্যাংকের পরিচালক ও চেয়ারম্যানরা দেশ ছেড়ে বিদেশে রয়েছেন। তারা ব্যাংকের বিভিন্ন সভায় অনুপস্থিত থাকলেও স্ব স্ব পদে কৌশলে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের 'বিকল্প পরিচালক' নিয়োগে কড়াকড়ি নীতিমালায় পদ হারাতে বসেছেন অনেক ব্যাংকের পরিচালক ও চেয়ারম্যান।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) কেন্দ্রীয় ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোর 'বিকল্প পরিচালক' নিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ব অনুমোদনের শর্ত জুড়ে দিয়েছে। যার কারণে কোনো পরিচালক যে কোনো কারণে দেশের বাইরে থাকলে তার পছন্দের মতো লোককে চাইলেই বিকল্প পরিচালক হিসেবে বসাতে পারছেন না।
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে জারি করা সার্কুলার অনুযায়ী, বিকল্প পরিচালক নিয়োগের ৭ কর্মদিবস আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হতো। তবে নিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ব অনুমোদন প্রয়োজন হতো না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডিরেক্টর আলা উদ্দিন বলেন, "অনেক পরিচালক তার অনুপস্থিতে 'বিকল্প পরিচালক' হিসেবে তার পছন্দের একজনকে নিয়োগ দিয়ে যান। যদিও একজন পরিচালক হতে বিভিন্ন ধরনের যোগ্যতা প্রয়োজন। তার ব্যবসায়ীক দক্ষতা, ব্যবসায় অন্তরিকতা, এবং ব্যক্তি হিসেবে সৎ কিনা এগুলো যাচাই প্রয়োজন। এ কারণেই আমরা এমন নির্দেশনা দিয়েছি।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, "নতুন এই শর্তটি খুবই সময় উপযোগী। অনেক ব্যাংকের পরিচালক ব্যাংকখাত থেকে হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। যদিও তাদের অনেকেই এখনও কাগজ কলমে ডিরেক্টর কিংবা চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন। তারা চাচ্ছেন, তাদের অনুপস্থিতে তাদের পছন্দের কাউকে 'বিকল্প পরিচালক' নিয়োগ দিতে।"
তিনি বলেন, "ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, পরপর তিনটি সভায় বা তিন মাস কোনো পরিচালক সভায় অংশ না নিলে তার পদ শূন্য হয়ে যায়। এরমধ্যে যেটি বেশি সময় হবে, সেটিই কার্যকর হয়।"
করোনার সময়ে বিদেশে বসে বা দেশে থেকে অনলাইনে ব্যাংকের সভায় অংশ নেওয়ার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তা করোনা কেটে যাওয়ার পরও চালু রাখা হয়। ফলে পরিচালনা পর্ষদের পাশাপাশি নির্বাহী, নিরীক্ষা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা একইভাবে সভায় অংশ নিতে পারতেন। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর সে সুযোগ তুলে নেওয়া হয়।
জানা যায়, আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও মেঘনা ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ এন আশিকুর রহমানকে একটি সভায় অনলাইনে যোগ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
এ ধরনের পরিচালকদের মধ্য রয়েছেন— ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের স্ত্রী, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাইয়ের স্ত্রী ও চাচাতো ভাই, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ছেলে, সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর ছেলে, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্যাহর স্ত্রী।
আওয়ামী লীগের মেয়াদে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে— এমন ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো— ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন, ন্যাশনাল, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, বাংলাদেশ কমার্স, আল-আরাফাহ্ ইসলামী, আইএফআইসি, এক্সিম ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)।
এরমধ্যে আটটিরই নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এস আলম গ্রুপের কাছে। এছাড়া, একটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, একটি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবার ও আরেকটি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরিস্থিতিতে মার্কেন্টাইল, সিটিজেন ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দেন।
পদ হারানোর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন আওয়ামী লীগের আমলে অনুমোদন পাওয়া ও দখল হওয়া ব্যাংকের পরিচালকরা। কারণ, এসব পরিচালকের মধ্যে শেখ পরিবারের সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ–সমর্থিত ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন।