প্রজনন মৌসুমে কক্সবাজার সৈকতে আবারও ভেসে আসছে মৃত কচ্ছপ
সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুমে ফের একের পর এক মৃত কচ্ছপের দেখা মিলছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টসহ উপকূল এলাকায়।
গত বছরের তুলনায় এবার ভেসে আসা মৃত কচ্ছপের সংখ্যা অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য বলছে, কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে গত দুইদিনে (শনি ও রোববার) ভেসে এসেছে ৬৮টি মৃত কচ্ছপ। এর আগে, গত ৪ জানুয়ারি থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে ভেসে এসছে আরও অন্তত ১৪টি মৃত কচ্ছপ। ফলে গত ২৪ দিনে ভেসে আসা মৃত কচ্ছপের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৪টিতে।
যদিও গত বছর (২০২৪ সাল) জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্টে ২৯টি মৃত কচ্ছপ পাওয়া গিয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে ৩টি মৃত ডলফিন, ১টি মৃত পরপইসও ভেসে এসেছিল সৈকতে।
রোববার বিকালে বাংলাদেশ সামুদ্রিক গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বোরি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া মৃত কচ্ছপের সংখ্যা নিশ্চিত করে বলেন, "সম্প্রতি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন এলাকায় কিছু সংখ্যক কচ্ছপের মৃতদেহ পড়ে থাকার খবর দেন স্থানীয়রা। এ তথ্যের ভিত্তিতে বোরি'র একটি গবেষক দল শনিবার সকাল থেকে সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে।"
তিনি জানান, "গবেষক দলটির সদস্যরা টেকনাফ উপজেলার সাবরাং জিরো পয়েন্ট থেকে পরিদর্শন কাজ শুরু করে। শনিবার প্রথমদিনে টেকনাফের সাবরাং জিরো পয়েন্ট থেকে উখিয়া উপজেলার রূপপতি এলাকা পর্যন্ত ১২টি কচ্ছপের মৃতদেহ এবং রোববার দ্বিতীয় দিনে রূপপতি থেকে সোনার পাড়া পর্যন্ত ৪৯টি, আর পেঁচারদ্বীপ থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত ৭টি কচ্ছপের মৃতদেহ উদ্ধার করে পরিদর্শন দল।"
বোরি'র এ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও বলেন, "উদ্ধারকৃত (মৃত) সবগুলো কচ্ছপই অলিভ রিডলে প্রজাতির। এগুলোর মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রী কচ্ছপও রয়েছে। উদ্ধার করা কচ্ছপগুলোর মধ্যে কিছু সংখ্যকের ১/২ দিন, কিছু সংখ্যকের ৭ দিন এবং কিছু সংখ্যকের ১০/১৫ দিন বা তারও আগে মৃত্যু হয়েছে।"
কী কারণে কচ্ছপগুলোর মৃত্যু হয়েছে তা নিশ্চিত করতে না পারলেও স্থানীয়দের তথ্যের বরাতে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া বলেন, "নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম। এ সময় কচ্ছপ উপকূলে ডিম দিতে আসে। জেলেদের জালে আটকা পড়ে, সমুদ্রে চলাচলকারী বড় নৌযানের ধাক্কায় কিংবা উপকূলে ডিম পাড়তে এসে কুকুরের আক্রমণে কচ্ছপগুলোর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। তবে তদন্তের পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।"
মৃত কচ্ছপগুলো উদ্ধারস্থলের আশপাশে বালি চাপা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
বোরির দেওয়া তথ্য মতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের সোনাদিয়া, হিমছড়ি, সোনারপাড়া, ইনানী ও টেকনাফ সৈকতে অন্তত ২৯টি মৃত কচ্ছপ পাওয়া গিয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে ৩টি মৃত ডলফিন, ১টি মৃত পরপইসও ভেসে এসেছিল।
প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) বলছে, সামুদ্রিক মা কচ্ছপ এখন মহাবিপদে রয়েছে। ১০ বছরেরও বেশি সময় আগে ২০০৩ সালে সংস্থাটির এক জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার উপকূলের ৫২ পয়েন্টে সামুদ্রিক মা কচ্ছপ ডিম দিতে আসত। ওই সময় এসব পয়েন্ট মা কচ্ছপের কাছে অত্যন্ত নিরাপদ পয়েন্ট ছিল।
সংস্থাটির উপ-প্রকল্প পরিচালক ড. শফিকুর রহমান জানান, "মা কচ্ছপের ডিম দেওয়ার সময় সাধারণত নভেম্বর থেকে শুরু, যা এপ্রিল-মে পর্যন্ত চলে। তারা রাতের বেলায় নির্জন উপকূলে এসে গর্ত তৈরি করে ডিম দেয়। সাধারণত একটি মা কচ্ছপ ৩০টি পর্যন্ত ডিম দেয়। ডিম দেওয়া শেষ করে তা মাটি, বালি বা অন্য কোনো জৈব পদার্থ দিয়ে ঢেকে দেয়। এরপর মা কচ্ছপ ফিরে যায় সাগরে।"
৬০ থেকে ৭০ দিনের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে ডিম থেকে বাচ্চা জন্ম নেয়। এরপর বাচ্চাগুলো গর্ত থেকে বের হয়ে সাগরে চলে যায় বলে জানান তিনি।
এটা প্রকৃতিকভাবে হয়ে আসছে বলে মন্তব্য করে শফিকুর রহমান বলেন, "১০ বছর আগে ৫২ পয়েন্টে মা কচ্ছপ ডিম দিতে এলেও বর্তমানে তা কমে ৩৪ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। মহেশখালীর সোনাদিয়া থেকে শুরু করে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত সৈকতের নির্জন এলাকায় এসব কচ্ছপ ডিম দিত। কিন্তু সমুদ্রপাড়ে ডিম দিতে এসে পুনরায় গভীর সাগরে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ এখন যেন আর নেই। ডিম দিতে এসে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে মা কচ্ছপ।"
নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (নেকম) প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম বলেন, "নির্জন সৈকতে কচ্ছপ ডিম দিতে আসে। কিন্তু নানান কারণে ডিম দেওয়ার স্থানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পর্যটনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি কক্সবাজার সৈকতে আলোকায়ন, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেওয়া, ডিম ছাড়ার মৌসুমে বিচে ডাইভিং, খেলাধুলা, সৈকতে হাঁটা ইত্যাদি কচ্ছপের ডিম দেওয়ার পরিবেশ নষ্ট করেছে। ক্রমাগত কচ্ছপের ডিম দেওয়ার স্থান কমছে।"
তিনি আরও বলেন, "মা কচ্ছপগুলো ডিম দিতে সমুদ্র থেকে উপকূলে আসা-যাওয়ার পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে সৈকতে পুঁতে রাখা মাছ ধরার অবৈধ কারেন্ট জালের কারণে। গভীর সাগরে ট্রলিং জালে আটকা পড়েও মারা যাচ্ছে মা কচ্ছপ। আবার সৈকতে এসে ডিম পারলেও সেই ডিম রক্ষা করা যাচ্ছে না।"
পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, "প্রতি বছর প্রজনন মৌসুমে মৃত কচ্ছপ পাওয়া যাচ্ছে। এসব কচ্ছপের শরীরে আঘাতের চিহ্নও থাকে। সাগরে পুঁতে রাখা মাছ ধরার জালে আটকা পড়লে জেলেরা লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে কিংবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে কচ্ছপকে হত্যা করে সমুদ্রে ফেলে দেয়।"
"আবার জোয়ারের পানিতে কচ্ছপগুলো উপকূলে ভেসে এলে কুকুর খেয়ে ফেলেছে। জেলেদের সচেতন করা, ডিম দেওয়ার স্থানটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি এবং সৈকতে কুকুরের বিচরণ রোধ করা জরুরি। তা না হলে কচ্ছপ রক্ষা করা যাবে না," যোগ করেন তিনি।