দুই দশকে এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরেও এনবিআর চলছে কাগজেকলমে
কর সংগ্রহ বাড়াতে ও করদাতাদের প্রদত্ত সেবা উন্নয়নের আশায় গত দুই দশকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ডিজিটাইজেশনে অন্তত এক হাজার কোটি টাকা ঢেলেছে সরকার। অথচ, এখনো অধিকাংশ কর-সংক্রান্ত কার্যক্রম চলছে সেই মান্ধাতার আমলের ম্যানুয়েল ব্যবস্থায় (কাগজকলমে)। এতে করদাতাদের যেমন হয়রানি হচ্ছে, তেমনি রাজস্বের ক্ষেত্রেও ক্ষতি হচ্ছে।
গবেষণা বলছে, কর প্রশাসনের সম্পূর্ণ ডিজিটাইজেশন হলে বাংলাদেশের রাজস্ব আদায় দ্বিগুণ হতে পারে। তবে ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের ট্যাক্স ব্যবস্থাপনায় অটোমেশন নিয়ে বিস্তর আলোচনা আর উদ্যোগ নেওয়ার পর দুই দশক পর এসে দেখা গেল, ট্যাক্স ব্যবস্থাপনাকে পেপারলেস করতে যে ১৬ ধরণের কার্যক্রম বাস্তবায়ন প্রয়োজন, এরমধ্যে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র তিনটিতে।
সম্প্রতি ন্যাশনাল এনবিআরের ই-ট্যাক্স ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের প্রস্তুত করা এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে, যা এনবিআরের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। প্রতিবেদনটি দেখেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
'ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন অব ইনকাম ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন' শীর্ষক ওই পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়, ইলেকট্রনিক ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (ই-টিআইএন), ইলেকট্রনিক ট্যাক্স রিটার্ন (ই-রিটার্ন) এবং ই-ট্যাক্স অফিস— এই তিনটি সিস্টেম কেবল চালু আছে। তা-ও এর সবই পুরোদমে এবং কার্যকরভাবে চালু করা যায়নি।
এর বাইরে বাদবাকী ১৩টি কার্যক্রম, যা প্রকৃতপক্ষে ট্যাক্স ব্যবস্থাপনাকে পেপারলেস করতে প্রয়োজন – তাতে অগ্রগতি নেই।
উদাহরণ হিসেবে ভ্যাট অটোমেশনের কথাই ধরুন, প্রায় এক দশকের প্রচেষ্টা ও ৩৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ের পরে— এরমাত্র কিছু কার্যক্রম আংশিকভাবে ডিজিটাইজ করা গেছে। সেলস একাউন্টিংয়ে স্বচ্ছতা আনতে বহুল প্রচারিত ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস সিস্টেম কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
এরপর বলা যায়, ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো কর্মসূচির কথাও। কাস্টমসের ব্যবস্থাপনাকে ডিজিটাইজ করতে সাত বছর আগে এই কর্মসূচি নেওয়া হয়। কিন্তু, এর ৬০০ কোটি টাকা বাজেটের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয়ের পর– সবেমাত্র আগামী মাসে এটির কার্যক্রম শুরু হতে চলেছে।
আরেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ– বন্ড অটোমেশনে ১০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হলেও এখনও তা পুরোদমে চালু হয়নি। আমদানি ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণের কিছু সেবা ডিজিটাইজ করা গেলেও– এখনও এর অধিকাংশই হচ্ছে ম্যানুয়াল সিস্টেমে।
এমনকি আমদানি পণ্যের দ্রুত খালাসের সুবিধার্থে নেওয়া— অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর সিস্টেম চালুর ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়েছে। পাঁচ বছর ধরে আলাপ-আলোচনার পর হাজারো আমদানি ও রপ্তানিকারকের মধ্যে মাত্র ১৪টি প্রতিষ্ঠান এই কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছে।
দুটি বাদে আয়কর অটোমেশনের প্রায় সব উদ্যোগই চালু করা যায়নি।
এসব নিয়ে রয়েছে গভীর হতাশা। কাস্টমস দিবস উপলক্ষে রোববার (২৬ জানুয়ারি) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর আয়োজিত এক সেমিনারে তাঁর অসন্তোষের কথা তুলে ধরে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডোর মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প ২০১৭ সালে শুরু হয়, কিন্তু এটি বাস্তবায়নে অনেক বছর লেগেছে। অবস্থাটা একবার চিন্তা করেন।
অটোমেশন প্রকল্পগুলোর অধিকাংশে অর্থায়ন করেছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা। অথচ, তাদের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও— ডিজিটাইজেশনের গতি মন্থরই রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মূল্য দিতে হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি ও করদাতাদের।
এনবিআরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি অনুযায়ী, কর ব্যবস্থার ডিজিটাইজেশনের লক্ষ্যে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের সমর্থনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে অন্তত আটটি উদ্যোগ নেওয়া হয়।
অথচ এখনও তৈরি করা হয়নি এনবিআরের কোনো নথিভুক্ত সাইবার সুরক্ষা নীতি। এনবিআরের তিনটি বিভাগ– ট্যাক্স, ভ্যাট ও কাস্টমসের মধ্যে ইন্টিগ্রেশনও করা যায়নি।
সম্পূর্ণ ডিজিটাইজেশনে দ্বিগুণ হতে পারে কর রাজস্ব
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ এবং জিডিপিতে করের অবদান (ট্যাক্স-টু-জিডিপি রেশিও) মাত্র ৭ শতাংশের কিছু বেশি থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৬ শতাংশে উন্নীত করতে— রাজস্বের ডিজিটাইজেশন অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একটি গবেষণা অনুযায়ী, গতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দেশগুলোর অন্তত ১২ শতাংশ ট্যাক্স-টু-জিডিপি রেশিও থাকা উচিৎ।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সুনির্দিষ্ট ও সামগ্রিক পদ্ধতির অভাব, প্রযুক্তিগত ও নকশার ত্রুটি, অপর্যাপ্ত দক্ষতা এবং তহবিলের অপব্যবহারের কারণে এনবিআর সম্পূর্ণ কর ডিজিটাইজেশন অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
গত মে মাসে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় বলা হয়, এনবিআরের বর্তমান কার্যক্রমের যে গতি তাতে ২০৩০ সালে রাজস্ব সংগ্রহ প্রায় ৯ লাখ ৯০ হাজার ক্যোঁতই টাকায় দাঁড়াবে বলে ধারণা করা যায়। তবে যথাযথভাবে ডিজিটাইজেশন করা গেলে — এর পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান টিবিএস বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে সরকার প্রায় ১০০টি পণ্য আর সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক বাড়ায়। কিন্তু, যথাসময়ে প্রকৃত ডিজিটাইজেশন যদি নিশ্চিত করতে পারতো, তাহলে এর চেয়ে বেশি রেভিনিউ স্বাভাবিক উপায়েই আসতো। আইএমএফ এর শর্ত মানতে গিয়ে মানুষের ওপর নতুন করে চাপ বাড়াতো হতো না।'
ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) এর সভাপতি মোহাম্মদ জাভেদ আখতার বলেন, 'একটি ডিজিটাল ট্যাক্স সিস্টেম ব্যবসার প্রক্রিয়াকে সহজতর করবে, এবং বাংলাদেশে যেসব স্বেচ্ছাচারী ও নির্বিচার সিদ্ধান্তের কারণে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বেড়ে যায়— সেগুলোকে দূর করবে।'
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সহ-সভাপতি মুনির হোসেন বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে হলে— রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সম্পূর্ণ অটোমেশন অপরিহার্য।'
ট্যাক্স ডিজিটাইজেশনে যেসব জায়গায় পিছিয়ে এনবিআর
এনবিআরের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কর প্রশাসনের আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে তিনটি ধাপ রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের মাঝামাঝি। কিন্তু বাংলাদেশকে যেতে হবে তৃতীয় ধাপে, যেখানে কর সংস্থাগুলো করদাতাদের নেচারাল ইকোসিস্টেমের সাথে একীভূত সিস্টেম তৈরি এবং পরিচালনা করে।
যে ১৩টি ক্ষেত্রে এনবিআর পিছিয়ে রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে– ইলেকট্রনিক সোর্স ট্যাক্স, ইলেকট্রনিক সাপোর্ট এবং ইলেকট্রনিক ট্যাক্স ওয়ার্ল্ড— যা ট্রান্সফার প্রাইসিং ও আন্তঃসীমান্ত তথ্য আদানপ্রদানের মতো আন্তর্জাতিক কর সংক্রান্ত বিষয়গুলো ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে রাজস্বের হিসাবরক্ষণ নিশ্চিত করে।
অন্যান্য ক্ষেত্রের মধ্যে আছে ট্যাক্স এজেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ইলেকট্রনিক ট্যাক্স লিটিগেশন ম্যানেজমেন্ট, ইলেকট্রনিক কানেকশন, ইলেকট্রনিক পেমেন্ট ভেরিফিকেশন, ইলেকট্রনিক অডিট অব ট্যাক্স কেস, ইলেকট্রনিক ট্যাক্স অফিস, ইলেকট্রনিক অপারেশন অব অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং কাগজপত্রে থাকা তথ্যকে ডিজিটাল মাধ্যমে রুপান্তর।
ইলেকট্রনিক ট্যাক্স ডিডাকশন অ্যাট সোর্স এবং ইলেকট্রনিক ট্যাক্স লেজার— এ দুটি ব্যবস্থা চালু হলেও বাস্তবে তেমন কার্যকর নয় বলে জানা গেছে।
বিশেষত কর পর্যালোচনা এখনও অনেক বেশি অনুমানের উপর ভিত্তি করে করা হয়; যেটি প্রায়ই ত্রুটিপূর্ণ বা ভুল অনুমানের জন্ম দেয়, একারণে করদাতাদের থেকেও অভিযোগ আসে।
এছাড়া, বিপুল পরিমাণ তথ্যের প্রক্রিয়াকরণও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে, যেকারণে সম্পূর্ণ কার্যকারিতে অর্জন করতে পারছে না কর ব্যবস্থা।
সুনির্দিষ্ট ও সামগ্রিক পদ্ধতির অভাব
২০০৫ সাল থেকে অন্তত ৭টি আয়কর অটোমেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। যারমাধ্যে মাত্র দুটি বাদে বেশিরভাগই ব্যর্থ হয় প্রযুক্তিগতত্রুটি, তহবিলের অপব্যবহার এবং কৌশলের ঘাটতির কারণে।
আয়কর ছাড়াও ভ্যাট ও কাস্টমস ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ডিজিটাইজেশনের লক্ষ্যে ১০টির বেশি প্রকল্প নেওয়া হয়, এরপরেও এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ মনে করেন, ডিজিটাইজেশন কৌশলের মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট ও সামগ্রিক পদ্ধতির অভাব থাকার ফলেই কর প্রশাসনে এর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়েছে।
একই মতপোষণ করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব এবং কিছু ক্ষেত্রে অনিয়মও বাড়তি বাধা হিসেবেও কাজ করেছে।
এছাড়া মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের অনীহাকে সমালোচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব কর্মকর্তারা আশঙ্কা করেন, ডিজিটাইজেশনের ফলে তাদের 'অবৈধ' আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।