অন্তর্বর্তী সরকারের মধুচন্দ্রিমা শেষ, গণতান্ত্রিক উত্তরণে উভয় সংকটে বাংলাদেশ: ক্রাইসিস গ্রুপ
গণতান্ত্রিক উত্তরণের যাত্রায় বাংলাদেশ এক উভয় সংকটে রয়েছে। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় যত এগোচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার তার প্রতিশ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করতে তত চাপের মুখে পড়ছে বলে মনে করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এর সদস্যদেশগুলো কোথায় শান্তির সম্ভাবনা বাড়াতে পারে, তা চিহ্নিত করে প্রতি বছর ক্রাইসিস গ্রুপ একটি 'ইইউ ওয়াচলিস্ট' বা 'ইইউ পর্যবেক্ষণ তালিকা' প্রকাশ করে থাকে। আজ বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) এবছরের তালিকাটি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে মলদোভা, কলম্বিয়া, উত্তর কোরিয়া, সুদান, গ্রেট লেকস, ইউক্রেন, সিরিয়া, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন এবং ইরানের পাশাপাশি বাংলাদেশ-ও রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) এর মতে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মধুচন্দ্রিমা এখন পুরোপুরি শেষ। রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ সংস্কার নিয়ে দরকষাকষি করায় এবং নির্বাচনী সুবিধার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায় এই বছর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বাড়তে পারে।
ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার পতনের পরপর অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন পক্ষের যে অকুন্ঠ সমর্থন পাচ্ছিল– তাতে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। এই অবস্থায়, উপযুক্ত ফলাফল দেওয়ার চাপের মধ্যে আছেন ইউনূস। তার সরকার রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যকার বিভেদ নিরসনে হিমশিম খাচ্ছে। আবার সরকার পরিচালনার দৈনন্দিন বিষয়েও সমালোচনার মুখে পড়ছে।'
'বাংলাদেশ: গণতান্ত্রিক উত্তরণে সংকট' শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বছর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বাড়তে পারে। কারণ, রাজনৈতিক দল, ছাত্রনেতা এবং ইসলামী গোষ্ঠীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়রা নির্বাচনের মাঠে সুবিধা লাভের জন্য প্রতিযোগিতা করছে।
প্রতিবেশী ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উত্তেজনার বিষয়টিও তুলে ধরেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। আইসিজি বলেছে, শেখ হাসিনার সরকার পতনের আগপর্যন্ত তাকে কট্টরভাবে সমর্থন দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় যা আরেকটি বাধা। 'এদিকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থাপনার ভার নিতে হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারকে, একইসঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের সাথে সীমান্তে অস্থিতিশীলতাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।'
ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশ-বিষয়ক সিনিয়র কনসালট্যান্ট থমাস কিয়ান বলেন, 'জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণেও অন্তর্বর্তী সরকার চাপের মধ্যে রয়েছে, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যবস্থাপনার উত্তরাধিকার হিসেবে তারা পেয়েছে। আর অর্থনীতিকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চলমান প্রচেষ্টার সুফল বাংলাদেশের জনগণের বাস্তবে পেতে আরও সময় লাগবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে এখনো টানাপোড়েন রয়েছে, আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।'
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টার বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেন কিয়ান। তিনি বলেন, এরপরও আগামী বছর বাংলাদেশের সামনে দেশটির জাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন এবং এটিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক করার একটি বিরল সুযোগ রয়েছে। এই লক্ষ্যে সংস্কার কমিশনগুলো কয়েকশ প্রস্তাব সম্বলিত প্রতিবেদন জমা দিতে শুরু করেছে।
'নির্বাচনী রাজনীতিতে বাংলাদেশের জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কার প্রক্রিয়ায় সমর্থন ও অন্তর্বর্তী সরকার যাতে দেশকে একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়, সেটা নিশ্চিত করতে আলাপ–আলোচনা, কারিগরি ও আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে বিদেশি অংশীদারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে''- আরও বলেন তিনি।
এর আগে গত বছরের আগস্টে ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রবেশ করেছে বলে পর্যবেক্ষেণ তুলে ধরা হয়।
ক্রাইসিস গ্রুপের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহাব এনাম খান টিবিএসকে বলেন, 'হানিমুন পিরিয়ড শেষ হয়েছে সেটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং এটি কঠিন রাজনৈতিক সত্য। সরকারও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দিকে যাওয়ার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তাঁরা সংস্কারের কথা বলছে, কিন্তু এই সংস্কারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্ভুক্তি বা সংহতির জায়গাটা ফাঁকা রয়ে যাচ্ছে।'
'এছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও সর্বোচ্চ দুর্বল অবস্থায় আছে, যা সরকারকে আরও গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিবে। তাই ক্রাইসিস গ্রুপের পর্যবেক্ষণ এবং বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশ যত দ্রুত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ফিরবে– স্থিতিশীলতার পক্ষে সেটা ততোই ভালো হবে'- তিনি যোগ করেন।
ড. শাহাব এনাম খান বলেন, সংস্কারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফেরত যাওয়া। আমি মনে করি, আইসিজির প্রতিবেদনটি গুরুত্বের সাথে নেওয়া উচিৎ। এসব বিশ্লেষণ অনুযায়ী সরকার যত দ্রুত পদক্ষেপ নেবে ততোই মঙ্গল। অর্থাৎ, আমাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।