ভারতে এক দশকে বাঘের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাঘের বসবাস এখন ভারতে। সর্বাধিক জনবসতিপূর্ণ এ দেশে বৈশ্বিক বাঘের আবাসস্থলের মাত্র ১৮ শতাংশ থাকার পরেও দেশটি বাঘ সংরক্ষণে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে। খবর বিবিসির।
গত এক দশকে দেশটিতে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে ৩ হাজার ৬০০-এর বেশি হয়েছে, যা বিশ্বের মোট বাঘের ৭৫ শতাংশ। বর্তমানে দেশটির ১ লাখ ৩৮ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার (৫৩ হাজার ৩৬০ বর্গমাইল) এলাকা জুড়ে এ বন্যপ্রাণী বসবাস করছে, যা যুক্তরাজ্যের প্রায় অর্ধেক আয়তনের সমান।
এসব অঞ্চলে প্রায় ৬ কোটি মানুষের বসবাস থাকলেও বাঘদের সহাবস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।
প্রখ্যাত গবেষণা সাময়িকী সায়েন্স-এ প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, বাঘদের পাচার ও আবাসস্থল হারানোর হাত থেকে রক্ষা, শিকারী প্রাণী সুরক্ষা, মানুষের সঙ্গে বন্যপ্রাণী সংঘাত কমানো এবং স্থানীয় জনগণের উন্নয়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমে এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
গবেষণার প্রধান লেখক যদবেন্দ্রদেব বিক্রমসিং ঝালা বলেন, আমরা সাধারণত মনে করি যে মানুষের ঘনবসতি বড় মাপের মাংসাশী প্রাণীদের (যেমন বাঘ) সংরক্ষণে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, মানুষের সংখ্যা নয়, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণ হিসেবে মালয়েশিয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে ভারতের তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব কম এবং অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হওয়া সত্ত্বেও বাঘ সংরক্ষণে সফলতা আসেনি।
গবেষকদের মতে, ভারতের সাফল্য দেখিয়েছে যে, সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে বাঘ রক্ষা করা সম্ভব, জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায় এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীরও উপকার হয়— যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে।
গবেষক যদবেন্দ্রদেব বিক্রমসিং ঝালা, নিনাদ অবিনাশ মুঙ্গি, রাজেশ গোপাল এবং কামার কুরেশির পরিচালিত এক গবেষণায় ২০০৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বাঘের বিস্তৃতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ভারত ২০০৬ সাল থেকে প্রতি চার বছর পরপর ২০টি রাজ্যের বাঘের আবাসস্থল পর্যবেক্ষণ করছে। এতে বাঘ, তাদের শিকারি প্রাণী, খাদ্য সরবরাহ ও পরিবেশের গুণগত মানের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
এই সময়ে ভারতে বাঘের আবাসস্থল ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বছরে গড়ে ২ হাজার ৯২৯ বর্গকিলোমিটার।
গবেষকরা দেখেছেন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে ভারতে বাঘ ও মানুষের সহাবস্থানের মাত্রা বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন।
মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, উত্তরাখণ্ড ও কর্ণাটকের মতো রাজ্যে উচ্চ জনসংখ্যার মধ্যেও বাঘ ও মানুষ একসঙ্গে বসবাস করছে।
গবেষকরা বলছেন, বাঘের সহাবস্থানের ক্ষেত্রে যেসব এলাকা ভালো কাজ করছে, তা সাধারণত অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী জায়গা। এখানে বাঘ-সংক্রান্ত পর্যটন এবং সরকারি সহায়তা রয়েছে, যা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে, উন্নয়নও কখনো কখনো সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ, যেখানে শহরায়ন বেশি, সেখানে বাঘের জন্য ভালো আবাসস্থল হারানোর ভয় থাকে।
তারা আরও বলেছেন, বাঘের সংরক্ষণ সফল হতে হলে শহরায়ন আর দারিদ্র্য যেন একসঙ্গে সমস্যা তৈরি না করে। যদি গ্রামীণ উন্নয়ন সঠিকভাবে হয় এবং মানুষও সচেতন থাকে, তাহলে বাঘের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। এটি ভারতের পরিবেশগত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে খাপ খায়।
সশস্ত্র সংঘাতও বাঘের জন্য বিপজ্জনক, কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে শিকারীরা বাঘের আবাসস্থলকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। যেমন, মাওবাদী সংঘাত যে এলাকায় রয়েছে, যেমন ছত্তিশগড় এবং ঝাড়খণ্ড, সেখানে বাঘের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তবে, কিছু অঞ্চলে, যেমন নগরজুনসাগর-শ্রীসাইলাম এবং আমরাবাদ, যেখানে সংঘাত কিছুটা কমে এসেছে, সেখানকার বাঘেরা ভালোভাবে পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে।
গবেষকরা বলছেন, যদি রাজনীতি শান্তিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসে, তাহলে এইসব অঞ্চলে বাঘের সংখ্যা আবার বৃদ্ধি পেতে পারে।
ভারতে এখনো কিছু এলাকা রয়েছে যেখানে বাঘ নেই, যেমন ছত্তিশগড়, ওড়িশা, এবং ঝাড়খণ্ড। এই অঞ্চলের মোট আয়তন প্রায় ১ লাখ ৫৭ হাজার বর্গকিলোমিটার।
গবেষকরা বলছেন, যদি বাঘদের পুনরায় ওই অঞ্চলে বসবাসের জন্য প্রস্তুত করা হয় এবং সুরক্ষিত এলাকাগুলোর মধ্যে সংযোগ তৈরি করা হয়, তাহলে প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা আবার বাঘের আবাসস্থল হয়ে উঠতে পারে।
বাঘদের পুনরুদ্ধার একটি বড় চ্যালেঞ্জ, বিশেষত যেখানে মানুষের ঘনত্ব বেশি এবং দারিদ্র্য রয়েছে। এর মধ্যে দুটি মূল ধারণা আছে—ল্যান্ড স্পেয়ারিং এবং ল্যান্ড শেয়ারিং। প্রথমটি বলছে, মানুষ ও বাঘদের আলাদা রাখা উচিত। আর দ্বিতীয়টি বলছে, মানুষ এবং বাঘদের একসাথে থাকতে হবে। যদিও এই দুটি ধারণাতেই কিছু সমস্যা রয়েছে, গবেষকরা বলছেন, দুটি ধারণাই বাঘ সংরক্ষণের জন্য দরকার।
এদিকে, ভারতের মধ্যে মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত বেড়ে চলেছে, যার ফলে বাঘের আক্রমণে মৃত্যুও ঘটছে। কিন্তু এটি বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে কিভাবে সম্পর্কিত?
গবেষক যাদবেন্দ্রদেব বিক্রমসিং ঝালা বলেন, 'প্রতি বছর ৩৫ জন মানুষ বাঘের আক্রমণে মারা যান, আর ১৫০ জন মারা যান চিতাবাঘের আক্রমণে। এর সঙ্গে, বন্য শূকরও অনেক মানুষের ক্ষতি করছে। এর পাশাপাশি, ৫০ হাজার মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায় এবং প্রায় দেড় লাখ মানুষ মারা যায় গাড়ির দুর্ঘটনায়'।
তিনি আরও বলেন, 'দুইশ বছর আগে, শিকারী প্রাণীর আক্রমণে মানুষের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু আজকের দিনে এটি অস্বাভাবিক, এবং এজন্যই এটি সংবাদে আসে। আসলে, বাঘ সংরক্ষিত এলাকাগুলোতে আপনি মারা যেতে পারেন গাড়ির দুর্ঘটনায়, বাঘের আক্রমণে নয়'।