সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের মাঝে টিকে থাকার লড়াইয়ে দেশের কৃষি খাত: অর্থনৈতিক সংস্কার বিষয়ক টাস্কফোর্স
বাংলাদেশের কৃষি খাত দেশের খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তি হলেও, বর্তমানে এটি নানা সংকট ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'ফসল উৎপাদন বাড়লেও কৃষি শ্রমিক সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং আধুনিক প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহারের কারণে কৃষকরা প্রত্যাশিত সুবিধা পাচ্ছেন না।'
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় উৎপাদনশীলতায় পিছিয়ে থাকা, জমির সংকোচন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং কৃষি রপ্তানি সক্ষমতার ঘাটতি এ খাতকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে রেখেছে।'
বলা হয়েছে, 'কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা ও প্রবৃদ্ধির হার কমছে। বর্তমানে কৃষি খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৩.৫%, যা ১৯৯০-এর দশকের ৪.৫% থেকে কমে এসেছে।'
আরও বলা হয়েছে, 'ভারতে এই হার ২.৯%, পাকিস্তানে ২.৭%, আর ভিয়েতনামে ২.৮%। যদিও উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে, তবে নতুন প্রযুক্তির অভাব এবং কৃষিজমির সংকোচনের ফলে কৃষিতে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।'
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের কৃষি শ্রমশক্তির প্রায় ৪৫% এই খাতে নিয়োজিত, কিন্তু তরুণ প্রজন্ম শহরমুখী হওয়ায় কৃষি শ্রমিক সংকট বাড়ছে। বর্তমানে দেশে প্রতি হেক্টরে মাত্র ৫০% কৃষক যান্ত্রিক চাষাবাদ করেন, যেখানে ভারতে এই হার ৮০%। শ্রমিকের অভাবে ধান ও পাট চাষ কমে যাচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে।'
আরও বলা হয়েছে, 'জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি বছর ৩ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ফসলহানি হচ্ছে। তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ধানের উৎপাদন ৫-৭% কমতে পারে। এর ফলে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি যেমন বাড়ছে, তেমনি খাদ্য সংকটের ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে।'
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে সেচ কাভারেজ ৫৮%, যা ভারতের ৪৮%, পাকিস্তানের ৫০% এবং ভিয়েতনামের ৬৫%। সার ব্যবহারে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও (প্রতি হেক্টরে ২৩৬ কেজি), উৎপাদনশীলতার দিক থেকে ভিয়েতনাম ও ভারতের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আধুনিক সেচ ও সার ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে।'
বলা হয়েছে, 'দেশের কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় ২৫% পর্যন্ত ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া, বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের রপ্তানি মাত্র ২.৫ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ভিয়েতনামের কৃষিপণ্য রপ্তানি ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। কৃষি রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে হলে কৃষিজাত পণ্যের প্রসেসিং, সংরক্ষণ এবং বৈশ্বিক মান নিশ্চিত করা জরুরি।'
প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।
বলা হয়েছে, 'ভারতে প্রেসিশন ফার্মিং, ভিয়েতনামে স্মার্ট ইরিগেশন এবং পাকিস্তানে ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থাপনা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা বাংলাদেশে এখনও সীমিত। বাংলাদেশে এখনও ধানকেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থা বিদ্যমান, যেখানে ভারত ও ভিয়েতনাম ফল, শাকসবজি ও মৎস্য চাষে বৈচিত্র্য এনেছে।'
প্রতিবেদনে কৃষি খাত নিয়ে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।
তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যান্ত্রিকীকরণ বাড়ানো। এজন্য সরকারি ভর্তুকি ও সহজ শর্তে ঋণের মাধ্যমে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার সুপারিশ এসেছে।
বাজার সংযোগ উন্নয়নের সুপারিশও করেছে টাস্কফোর্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সংরক্ষণাগার ও রপ্তানি নীতিমালা সংস্কার করতে হবে।'
লবণাক্ত ও অনাবৃষ্টিপ্রবণ এলাকায় লবণসহিষ্ণু ও খরা সহিষ্ণু ফসলের চাষ বাড়ানো, উচ্চফলনশীল বীজ, আধুনিক সেচ ব্যবস্থা ও ডিজিটাল কৃষি প্রযুক্তির সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।