চুনিয়াপাড়ার চুন তৈরির কারিগররা ভালো নেই
গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ চুন তৈরি করত বলে গ্রামের নাম চুনিয়াপাড়া। একসময় এ গ্রামের প্রায় চার হাজার মানুষ এই পেশায় জড়িত ছিল। এ পেশায় জড়িতদের বলা হয় পঞ্চমী বা জুগে। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের বিপরীতে সঠিক মূল্য না পাওয়ায় অনেকেই এই পেশা ছেড়ে যুক্ত হয়েছে নতুন পেশায়, ফলে দিন দিন কমে যাচ্ছে চুন তৈরির শ্রমিক। বর্তমানে চুনিয়াপাড়ায় এক থেকে দেড়শ মানুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত।
স্থানীয় চুন তৈরির কারিগর বা পঞ্চমীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে তারা চুন তৈরি করত শামুক বা ঝিনুকের খোলসের পুড়িয়ে। ঝিনুকের খোলস পুড়িয়ে যে চুন তৈরী করা হয় তা মানুষের শরীরের জন্য উপকারী। এই চুন খেলে পেটের সমস্যা, অম্লের সমস্যা, শ্লেমা, ক্রিমি, শরীরের ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পুরন, হাড় ক্ষয়, দাতের ক্ষয়, জন্ডিসসহ নানা রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। পাশাপাশি মাইগ্রেন, স্বাভাবিক মাথাব্যথা, ন্যাসাল পলিপ, হাড় ফ্রাকচার, চুল পড়ে যাওয়া, নরমাল ডেলিভারীর জন্যও এই চুন বেশ কার্যকর। এছাড়া এ চুন খেলে শরীরের চামড়া ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু বর্তমানে সময়ের পালাবদলে চুন তৈরির উপকরণ বদলে গেছে। চুন তৈরিতে এখন পাথরের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। পাথরের তৈরি চুনে চুনাপাথর ও বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। এই চুন ঘরবাড়ি চুনকাম করার কাজেও ব্যবহার করা হয় যা মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
কিভাবে চুন তৈরী করা হয়
চুন তৈরীর জন্য গোলাকার বিশিষ্ট মাটির বিশেষায়িত চুলা তৈরী করা হয়। আকার-আকৃতিতে বেশ বড় এই চুলায় প্রথমে মাটির হাড়ি রেখে তার ওপর খড়ি কিংবা জ্বালানী দিয়ে সাজিয়ে ঝিনুকের খোলস রাখা হয়। চুলায় প্রথমে কাঠের টুকরা এরপর রাখা হয় শামুক বা ঝিনুকের খোলস। এরপর ঝিনুকের ওপর আবারও কাঠের টুকরা রাখা হয়। এভাবে বেশ কয়েকটি স্থরে কাঠের টুকরা ও শামুক বা ঝিনকের খোলস রাখা হয়। এরপর আগুন দিয়ে সেসব পোড়ানো হয়। মূলত ঠিক পোড়ানো নয় বরং আগুন দিয়ে অধিক উষ্ণ ধোয়া ছড়ানো হয় কাঠের মাধ্যমে। এরপর সেসব শামুক বা ঝিনুকের খোলসগুলো বের করে ছাকুনি দিয়ে ছাকা ও পরিস্কার করা হয়। পরে সেগুলো আবার চুর্ণ করা হয়। পরে চুর্ণ করা পোকা শামুক বা ঝিনুকগুলো গর্তে রেখে পানি ঢেলে প্রায় ৩ ঘন্টা থেতলানো হয়। এরপর সেগুলো চুন হয়ে যায়। পরে তরল চুনগুলো কাপড়ের নেটে ছেকে বাজারজাত করা হয়। চুন তৈরির এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে প্রায় ৫ ঘন্টা লাগে। এসব শামুক বা ঝিনুকের খোলসগুলো বিভিন্ন এলাকার আদিবাসী বা যারা শামুক ও ঝিনুকের মাংস খায় তাদের কাছ থেকে ক্রয় করে আনেন তারা।
১৫ কেজির এক বস্তা শামুক বা ঝিনুকের দাম ২০০ টাকা। আর সেটি দিয়ে প্রায় ৩০ কেজি চুন হয়। এক মন চুন বিক্রি হয় ৬০০ টাকা দরে। খোলস ক্রয় থেকে এক মন চুন প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যয় হয় প্রায় ৩০০ টাকা। এক মন চুনে খরচ বাদ দিয়ে তাদের মুনাফা হয় ৩০০ টাকা।
চুন পেশায় জড়িতদের সমস্যা
জেলার সদর উপজেলার চুনিয়াপাড়া গ্রামে প্রায় দেড়শ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় এই ব্যবসা চলে আসছে। এখনও প্রায় অর্ধ শতাধিক মানুষ এর সাথে জড়িত। তবে গত কয়েক বছর ধরে নানামুখী সমস্যার কারণে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঢুকছেন এলাকার মানুষজন।
চুনিয়াপাড়ার ৩২ বছরের স্বপন বর্তমানে স্বপন পত্রিকা বিক্রি ও বিলি পেশার সাথে জড়িত। চুন তৈরী ও বিক্রি পেশার সাথে যুক্ত থাকলে সামনের দিনে টিকে থাকতে পারবে না জানিয়ে তিনি জানান, আমার বাবা-দাদারা বহুকাল থেকে এই পেশার সাথে জড়িত ছিল। কিন্তু এখন উপার্জন কমে গেছে। এজন্য অনেকেই ভ্যান-রিক্সা চালাচ্ছেন, ছোট-খাটো মুদি দোকানদারী করছেন। স্বপন জানায়, আগে এখানকার চুন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় যেত।
৭০ বছরের বাবু দেবনাথ জানান, আমার বাবা-দাদা চৌদ্দ পুরুষ এই পেশায় জড়িত ছিলেন। আমি আর আমার ছেলেরাও এই পেশার সাথে জড়িত। কিন্তু এই পেশায় থেকে বাড়ি কিংবা জমিজমা রং করা এমনটি হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ করে বাড়ী থেকে ৩/৪ হাজার টাকা বের করব এমনটা সম্ভব নয়। তবে এখন আমরা চুন তৈরীর পাশাপাশি অন্যের বাড়িতে বা কৃষি শ্রমিকের কাজ করছি।
৬০ বছরের লালবাবু দেবনাথ এই পেশায় থেকে কোনো উন্নতি নেই জানিয়ে জানান, এখন আমাদের দিন কোনোরকমে চলে যাচ্ছে। মিনু বালা তার সমস্যার কথা জানিয়ে জানান, এখন আগের মতো ঝিনুক পাওয়া যায় না। ঝিনুকের দামও বেশি বর্তমানে ১২ টাকা কেজি- খড়ির দাম বেশি।
একই এলাকার মঙ্গল চন্দ্র দেবনাথ জানান, চুন তৈরী করা যে কত কষ্ট তা কেউ বোঝে না। সরকারীভাবে কোন সহযোগিতা নেই। এনজিও থেকে লোন নিতে হচ্ছে। বাজারে চুনের মূল্য নেই। সরকার যদি কোনভাবে আমাদেরকে সহযোগিতা করতো তাহলে আমাদের অনেক উপকার হতো।
নেপালী রানী রায় জানান, এই চুন তৈরীতে আমি ও আমার স্বামী একসাথে কাজ করি। কিন্তু উপার্জন কম, বাচ্চাদের ঠিকভাবে খাওয়ানো ও লেখাপড়া করাতে পারি না। পরিশ্রম অনুযায়ী চুনের দাম কম। তাই আমার স্বামী অনেক সময়ই দিনমজুরের কাজ করতে হয়।
পূর্ণবাবু দেবনাথ জানান, যদি চুন খুচরা বিক্রি করি তাহলে ৮০০ টাকা মন। আর যদি পাইকারী বিক্রি করি তাহলে ৬০০ টাকা মন। এটা দিয়ে শুধু পেট চলে। ঋণ করেই ব্যবসা করি আর দিনযাপন করি।
ববিতা বালা জানান, সবস্থানেই উন্নতি হলেও আমাদের এলাকায় কোন উন্নতি নেই। এত কষ্ট করি চুন তৈরী করি, কিন্তু আমাদের দিকে কারও কোন নজর নেই।
দিনাজপুরের নিমতলা এলাকায় ৩৬ বছর ধরে তৈরী পান বিক্রির ব্যবসা করে আসছেন শ্রী নন্দু প্রসাদ। মাধব পান ষ্টোর নামের তার দোকানে শুধু খুচরা হিসেবেই নয় বরং বিয়ে, আকিকা, জন্মদিন, মুখেভাতসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে রকমারী পান অর্ডার নিয়ে পাইকারী হিসেবে সরবরাহ করা হয়। তার দোকানে রয়েছে নবাবী পান (৫০ টাকা পিস), ভালোবাসা পান (৪০ টাকা পিস), তৃপ্তি পান (৩০ টাকা পিস), সুন্দরী পান (২৫ টাকা পিস), সুইট পান (২০ টাকা পিস), শাহী পান (১৫ টাকা পিস), তবক পান (১৫ টাকা পিস), মিষ্টি পান (১০ টাকা পিস), মশলা পান (৫ টাকা পিস)সহ বিভিন্ন রকমের পান। তিনি জানান, পান খেতে চুন লাগবেই। বর্তমানে চুনের কেজি ২০ টাকা। দামে সমস্যা নয় তবে চুনের মান ভালো হলে পানের স্বাদ ভালো হয়। এজন্য চুন তৈরীতে সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন তেমনিভাবে প্রয়োজন গুরুত্ব দেয়া।
তার দোকানের পানক্রেতা বিপুল চন্দ্র সরকার জানান, ভারি খাবারের পর পান খাওয়া মানেই তৃপ্তি। তবে চুন না খেলে পানের কোন গুন থাকে না। কথায় আছে, পান খাওয়ার পর না খাই চুন, সেই পানের কি বা গুন। আরেক ক্রেতা রফিুকুল ইসলাম জানান, আমি আসলে শখ করে পান খাই। মাংস, বিরিয়ানি, পোলাও কিংবা যে কোন মজাদার খাবার গ্রহনের পর পান খেলে তৃপ্তি বাড়ে। পান এবং চুন দুটো মিলিয়ে কিছু মশলা দিয়ে খাওয়াটার তৃপ্তিই আলাদা।
চুন তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, যারা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে চুন বানানোর এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের পরিশ্রমের যথাযথ মূল্য নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজর দেয়া উচিত।