কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার ‘ইয়র্কশায়ার রিপারে’র মৃত্যু
'ইয়র্কশায়ার রিপার' নামে কুখ্যাত ব্রিটিশ সিরিয়াল কিলার পিটার সাটক্লিফ যুক্তরাজ্যের এক হাসপাতালে মারা গেছেন। ৭৪ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন দেশটির কারা বিভাগের এক মুখপাত্র।
১৯৭০-এর দশকের শেষ ভাগে ইংল্যান্ডের কাউন্টি ডারহ্যামে ১৩ নারীকে হত্যা ও সাতজনকে হত্যাচেষ্টার দায়ে ২০ দফা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড কারাগারে বন্দি ছিলেন সাটক্লিফ।
কারা বিভাগের মুখপাত্র বলেন, 'এইচএমপি ফ্র্যাঙ্কল্যান্ডের কারাবন্দি পিটার কুনান (সাটক্লিফ) ১৩ নভেম্বর (শুক্রবার) হাসপাতালে মারা গেছেন।'
জানা গেছে, কারাগার থেকে তিন মাইল দূরের ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অব নর্থ ডারহ্যামে ভর্তি করা হয়েছিল তাকে। এর আগে, স্থূলতা ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত থাকলেও চিকিৎসা নিতে বারবার অস্বীকার করেছিলেন তিনি।
দুই সপ্তাহ আগে হৃদরোগে আক্রান্ত সন্দেহে তাকে হাসপাতালটিতে ভর্তি করা হয়। তিনি করোনাভাইরাসেও আক্রান্ত ছিলেন।
১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সময়কালে হাতুড়ি ও স্ক্রুড্রাইভার ব্যবহার করে নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছিলেন ওই সিরিয়াল কিলার। মূলত নারীরাই ছিল তার টার্গেট। তার হাতে প্রাণ হারানো সবচেয়ে কম বয়সী নারীর বয়স ছিল ১৬ এবং বেশি বয়সীর ৪৭।
সাটক্লিফের হাতে যে ১৩ নারী প্রাণ হারিয়েছেন:
- উইলমা ম্যাকক্যান: বয়স ২৮। লিডসের চ্যাপেলটাউনের অধিবাসী। খুন হন ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে।
- এমিলি জ্যাকসন: বয়স ৪২। লিডসের মর্লির অধিবাসী। খুন হন ১৯৭৬ সালের ২০ জানুয়ারি।
- ইরেন রিচার্ডসন: বয়স ২৮। লিডসের চ্যাপেলটাউনের অধিবাসী। খুন হন ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি।
- প্যাট্রিসিয়া অ্যাটকিনসন: বয়স ৩২। ব্র্যাডফোর্ডের ম্যানিংহ্যামের অধিবাসী। খুন হন ১৯৭৭ সালের ২৪ এপ্রিল।
- জেনি ম্যাকডোনাল্ড: বয়স ১৬। লিডসের অধিবাসী। খুন হন ১৯৭৭ সালের ২৬ জুন।
- জেন জর্ডান: বয়স ২১। ম্যানচেস্টারের অধিবাসী। খুন হন ১৯৭৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ১১ অক্টোবরের মধ্যে।
- ইয়োভেনে পিয়ারসন: বয়স ২২। ব্র্যাডফোর্ডের অধিবাসী। খুন হন ১৯৭৮ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ২৬ মার্চের মধ্যে।
- হেলেন রিক্টা: বয়স ১৮। হাডার্সফিল্ডের অধিবাসী। খুন হন ১৯৭৮ সালের ৩১ জানুয়ারি।
- ভেরা মিলওয়ার্ড: বয়স ৪০। ম্যানচেস্টারের অধিবাসী। খুন হন ১৯৭৮ সালের ১৬ মে।
- জোসেফিন হোয়াইটেকার: বয়স ১৯। হ্যালিফ্যাক্সের অধিবাসী। খুন হন ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল।
- বারবারা লিচ: বয়স ২০। ব্র্যাডফোর্ডে হাঁটতে বের হয়ে খুন হন ১৯৭৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর।
- মার্গারিটা ওয়ালস: বয়স ৪৭। লিডসের অধিবাসী। খুন হন ১৯৮০ সালের ২০ আগস্ট।
- জ্যাকুলিন হিল: বয়স ২০। হ্যাডিংলিতে খুন হন ১৯৮০ সালের ১৬ নভেম্বর।
সাটক্লিফকে ধরার জন্য ছয় বছর ধরে আড়াই মিলিয়ন ঘণ্টা ব্যয় করতে হয় পুলিশকে। কেননা, বারবার পুলিশের চোখে ধোঁকা দিয়েছিলেন তিনি। সর্বশেষ গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পুলিশ তাকে নয় বার ধরেও ছেড়ে দেয়, হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে।
১৯৭৬ সালে লিডসে নিজের বাড়ির কাছে ২০ বছর বয়সী মার্সেলা কক্সটনকে আচমকা হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়। তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও যৌনকর্মী ছিলেন না বলে তাকে 'রিপার ভিকটিম হিসেবে' গণ্য করা হয়নি। অন্যদিকে, হাতুড়ি হাতে একটি পতিতাপল্লীতে ঢোকার দায়ে ১৯৬৯ সালে সাটক্লিফের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা এবং তার পরিচয় ফাঁস করে দিতে বেনামে তারই বন্ধু ট্রেভর বার্ডসেলের লেখা চিঠি পুলিশের মনোযোগ এড়িয়ে যায়।
সেই চরম উৎকণ্ঠার দিনগুলোতে ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ কনস্টেবল জর্জ ওল্ডফিল্ড ওই খুনির একটি টেপ বার্তা পেয়ে ভুল পথে পরিচালিত হন। পরে দেখা যায়, সেটি ধোঁকা ছিল।
ওল্ড বেইলিতে বিচারকালে সাটক্লিফ বলেছিলেন, 'এত ধরনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন যে তারা (পুলিশ) এত দিন আমাকে ধরতে পারেনি, এ সত্যি এক অলৌকিক ব্যাপার!'
১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে এক যৌনকর্মীকে ভুয়া নম্বর প্লেট লাগানো নিজের বাদামি রঙা রোভার কারে তুলে নেন সাটক্লিফ। সেই গাড়ি থামিয়ে, গ্লাভ কমপার্টমেন্টে স্ক্রুড্রাইভার খুঁজে পান পুলিশ কর্মকর্তারা। গাড়িটি থেকে ৫০ ফুট দূরে খুঁজে পান একটি হাতুড়ি ও ছুরি। আসলে, পুলিশ গাড়ি থামানোর পর পার্শ্ববর্তী এক দালানের টয়লেটে যাওয়ার অনুমতি নিয়ে, সেখানে ওই অস্ত্রগুলো ফেলে দিয়েছিলেন সাটক্লিফ।
সেবার এই চোর-পুলিশ খেলার অবসান ঘটে সাটক্লিফের অপ্রত্যাশিত স্বীকারোক্তিতে: 'ঠিক আছে, বলছি, আমি জানি আপনারা কী খুঁজছেন। আমিই ইয়র্কশায়ার রিপার। ওই নারীদের আমিই মেরেছি।'
তার বিস্তারিত স্বীকারোক্তি নিতে সময় লেগেছিল ২৪ ঘণ্টা। এ সময়ে তিনি নিজের স্ত্রী সোনিয়াকে স্টেশনের কাছে নিয়ে আসার অনুরোধ জানান, যেন তার কাছে খুনি পরিচয় প্রকাশ করতে পারেন।
১৯৮১ সালের মে মাসে বিচারের জন্য সাটক্লিফকে ওল্ড বেইলিতে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি দাবি করেন, ঈশ্বরের দেখানো পথেই তিনি যৌনকর্মীদের খুন করেছেন!
সাটক্লিফের প্রথম শিকার হিসেবে পরিচিত উইলমা ম্যাকক্যানের ছেলে রিচার্ড ম্যাকক্যান বলেন, ওই খুনি বহু মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছেন। 'আমার ধারণা, বিংশ শতকে সেই মানুষগুলোর একজনের মতোই তিনি চিরকাল নিন্দিত হবেন, যে দলে রয়েছেন হিটলার,' স্কাইনিউজকে বলেন রিচার্ড।
'এটি স্রেফ কোনো মাতালের কাজ ছিল না; তিনি ভেবে-চিন্তে হাতিয়ার নিয়ে একের পর এক খুন করেছেন।'
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান