ক্যাশলেস সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় আসছে ‘ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম’
কাঁচাবাজার, বাড়ির পাশের মুদি দোকান, স্ট্রিট ফুড কিংবা চেইনশপের কেনাকাটা বা সেবাগ্রহণের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেনদেনটা হয় নগদ অর্থে। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হলেও খুচরা কেনাবেচার মোট লেনদেনে তার অংশ খুবই সামান্য। বড় ব্যবসা বা সেবা এবং সাপ্লাই চেইনের লেনদেনেরও বেশিরভাগই হয় নগদ অর্থের মাধ্যমে।
এ অবস্থায় ব্যয়বহুল নগদ অর্থে লেনদেন কমিয়ে ব্যাংক ও এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডারদের (পিএসপি)-এই তিন মাধ্যমে লেনদেনের একটি ডিজিটাল ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে যাচ্ছে সরকার।
সোমবার 'ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেম' নামের এই পদ্ধতি পরিচালনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এই সিস্টেম হবে দক্ষ ও ব্যয়সাশ্রয়ী এবং তাতে অনেক মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ঘটবে।
অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এটি ক্যাশলেস সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মোবাইলে অ্যাপভিত্তিক লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের প্রসার, ব্যাংকিং খাতের প্রযুক্তিগত উন্নতি, সার্বজনীন কিউআর এবং ই-কেওয়াইসির প্রচলণের কারণে দেশে এরকম একটি সিস্টেম গড়ে তোলার উপযুক্ত পরিবেশ বিরাজ করছে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে এখন থেকে শ্রম নির্ভর অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং প্রান্তিক পণ্য বিক্রেতা ও সেবা প্রদানকারীরাও সহজেই ব্যাংক বা মোবাইল হিসাব খুলতে পারবেন।
একাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা পেশাজীবি সমিতি থেকে গ্রাহকের পেশার সত্যায়ন করে নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংক কিংবা সার্ভিস প্রোভাইডার কিংবা তার প্রতিনিধি কর্তৃক সরাসরি তত্ত্বাবধানের ব্যবসায়ীর কিংবা পেশাজীবীর বাস্তব অবস্থা নিশ্চিত করে একাউন্ট খুলতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এই উদ্যোগের ফলে খুচরা পর্যায়ের লেনদেন ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের হিসাব অর্থনীতির মূল ধারায় সংযোজন হবে। পাশাপাশি অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের একটি ডাটাবেজও সরকারের হাতে থাকবে।
তিনি বলেন, ক্ষুদ্র বা অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নগদ টাকায় লেনদেন করায় সঞ্চয় করতে পারেন না। এখন যেহেতু তাদের একাউন্ট খোলার সুবিধা থাকবে, তাতে একাউন্টের স্থিতির একটা অংশ সঞ্চয়ও হবে। এতে ওই সব ব্যবসায়ীরা আরো বিনিয়োগ করার সুযোগ পাবেন। পাবেন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সুবিধাও।
এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ এর (এবিবি) সাবেক সভাপতি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে ব্যাংক একাউন্টে গ্রাহকের ওপর যে এক্সাইজ ডিউটি আরোপ করা আছে, এসব একাউন্টের গ্রাহকদের ছাড় দেয়ার বিষয়টি রাজস্ব বোর্ডকে ভাবতে হবে। ক্যাশলেস সোসাইটি জনপ্রিয় করতে চাইলে এই ভাবনার প্রয়োজন আছে।
নতুন এই উদ্যোগে মোবাইল ফাইনান্সিয়াল সার্ভিসেই (এমএফএস) লেনদেন বেশি হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিকাশের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, এটি একটি বৈপ্লবিক উদ্যোগ। অনেক দিন থেকেই এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো এই সুযোগ দেয়ার দাবি করে আসছিল।
তিনি বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পের বেতন থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন ভাতা মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই টাকা আবার নগদায়ন করে কেনাকাটা করা হচ্ছে।
অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য যদি বিকাশ একাউন্ট খোলা যায় তাহলে একাউন্টের টাকা দিয়েই একজন গ্রাহক লেনদেন করতে পারবেন। ক্যাশ আউট করে নগদ টাকা হাতে নিতে হবে না- তিনি বলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগের প্রশংসা করে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যাতে এ ধরনের একাউন্ট খোলে এবং লেনদেনে উৎসাহী হয় সেজন্য ঢাকা চেম্বারের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
এই উদ্যোগের ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড অর্থনীতির মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত হবে। ব্যাংকের কাছে তাদের একটি তালিকা থাকবে। ব্যবসা সম্প্রসারণে তারা ঋণও নিতে পারবেন। এতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বড় উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস ডিপার্টমেন্টের সার্কুলারে বলা হয়, ব্যাংক ও এজেন্ট ব্যাংকিং এ ব্যক্তিক চলতি হিসাব খোলার ক্ষেত্রে কেওয়াইসি এবং ই-কেওয়াইসি নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। এই ধরনের একাউন্টে কোন লেনদেন সীমা প্রযোজ্য হবে না। তবে ই-কেওয়াসি দিয়ে খোলা হিসাবের ক্ষেত্রে মাসিক লেনদেন ও এককালীন সর্বোচ্চ স্থিতি ১০ লাখ টাকার বেশি হতে পারবে না।
ই-কেওয়াইসি ছাড়া খোলা একাউন্টের ক্ষেত্রে লেনদেনের সীমা থাকা উচিত বলে মনে করেন মিউচুয়াল স্টাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
তিনি জানান, আইন অনুযায়ী সব ধরনের একাউন্টের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সীমা থাকে। ব্যাংক ও এজেন্ট ব্যাংকিং কর্তৃক নিজস্ব কর্মকর্তার সরাসরি তত্বাবধানে অথবা নিয়োগকৃত প্রতিনিধির মাধ্যমে এ হিসাব খুলতে হবে।
এমএফএস একাউন্ট খোলার নির্দেশিকায় বলা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে একাউন্ট খোলা যাবে। কারো সাধারণ এমএফএস একাউন্ট থাকলে একই পরিচয়পত্র দিয়ে নতুন একাউন্ট খোলা যাবে।
এজেন্টের মাধ্যেমে এই একাউন্ট খোলা যাবে না। সার্ভিস প্রোভাইডারের নিজস্ব কর্মকর্তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধান বা প্রোভাইডারদের নিয়োগ করা প্রতিনিধির মাধ্যমে হিসাব খুলতে হবে।
মোবাইল ব্যাংকিং এ ৬ ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে দৈনিক ও মাসিক লেনদেন সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। দৈনিক সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা এবং মাসিক সর্বনিম্ন ১ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন করা যাবে। এই হিসাবের ক্ষেত্রে এককালীন সর্বোচ্চ স্থিতি হবে ৫ লাখ টাকা।
পেমেন্ট সার্ভিস প্রোইডার কর্তৃক হিসাব (ই-ওয়ালেট) খোলার ক্ষেত্রেও কেওয়াইসি অথবা ই-কেওয়াইসি নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। যিনি একাউন্ট খুলবেন তার পেশা, একাউন্ট খোলার যোগ্যতা এবং গ্রাহকের নিবন্ধিত মোবাইল নাম্বার নিজস্ব কর্মকর্তা বা প্রতিনিধির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে।
পিএসপি হিসাবে মাসিক লেনদেন ১০ লাখ টাকা অতিক্রম করবে না এবং এককালীন সর্বোচ্চ স্থিতি ৫ লাখ টাকার বেশি হবে না।