দীর্ঘসূত্রতার খপ্পরে পিতামাতার ভরনপোষণ আইন
ঢাকার একটি আদালতের বারান্দায় অপেক্ষমান পঁচাশি বছর বয়সী গনি ভুঁইয়া। খানিক পরই বিচারকের এজলাশে তাঁর মামলাটির শুনানি শুরু হবে। রাজধানীর রাযেরবাজার এলাকায় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন তিনি। তাঁরই তৈরি ওই ভবনে তার সন্তানরাও থাকেন। সন্তানদের কাছ থেকে খোরপোশ দাবি করে একটি মামলা করেছিলেন এই পিতা।
এবারই প্রথম নয়, মামলাটির শুনানি হয়েছে কয়েকবার। গণি ভূঁইয়াও বারবার এসেছেন এই একই আদালতে। এখনও মামলাটির ফয়সালা হল না।
তিনটি সন্তান তাদের— দুটি মেয়ে আর একটি ছেলে। গণি ভূঁইয়ার কষ্টার্জিত অর্থে কেনা পাঁচতলা বাড়ির মালিক এখন ওরাই। অথচ সন্তানদের মানুষ করতে অনেক কষ্ট করেছেন তিনি। বারো বছর ছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশ, ইরাকে ও সৌদি আরবে। আর সেখানে কাজ করার টাকা দিয়েই বানিয়েছিলেন পাঁচতলা ওই বাড়ি।
দু’মেয়ের একজন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। আর ছেলে বেসরকারি কোম্পানির চাকুরে। ছেলেমেয়েরা মা-বাবাকে বাড়িতে থাকার একটা বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন বটে, কিন্তু তাদের রোজকার খরচাপাতি দেন না। ফলে প্রবীণ এই দম্পতিকে আর্থিকভাবে কঠিন সংগ্রামের মধ্যে কাটাতে হচ্ছে।
গণি ভূঁইয়া তাই যোগাযোগ করেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানটি এ ধরনের ঘটনায় আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে।
ব্লাস্টের পক্ষ থেকে প্রথমে বিবাদীদের নোটিশ পাঠানো হয়। তাদের মধ্যস্থতায় সমাধানে পৌঁছুতে বলা হয় তাদের। কিন্তু বিবাদীরা নোটিশের জবাব দেননি।
এরপর সংস্থাটি গণি ভূঁইয়া ও তাঁর স্ত্রীর পক্ষে ঢাকা মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট-৫-এ একটি মামলা দায়ের করে। পিতামাতার ভরনপোষণ আইন অনুসারে মামলাটি করা হয়।
কয়েক বারের শুনানিতে আদালত দু’পক্ষের বক্তব্য শুনেছেন। গণির ছেলেমেয়েরা জামিনও পেয়েছেন। ৬ অক্টোবর গণির ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনীয় দলিলপত্র আদালতে উপস্থাপনের কথা। গত সোমবারে আদালত এ আদেশ দেন।
গণির মতো বাংলাদেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ সন্তানদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা পান না।
‘হেলপএইজ ইন্টারন্যাশনাল’ প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে তাদের অধিকার বুঝে নিতে সহযোগিতা করছে। তাদের সঙ্গে যৌথভাবে একটি পরিসংখ্যান তৈরি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ। ওই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, দেশের ৮৩.৩ শতাংশ প্রবীণ পরিবারের সদস্যদের অবহেলা ও অশ্রদ্ধা পাবার কথা বলেছেন। যথেষ্ট আর্থিক সমর্থন না পাবার অভিযোগ করেছেন ৫৪.৪ শতাংশ। আর ৩৯.৬ শতাংশ বলেছেন শারীরিকভাবে নির্যাতিত হবার কথা।
পরিবারের আপনজনদের হাতে শারীরিকভাবে নির্যাতিত প্রবীণদের ৫৪.৫ শতাংশই নারী।
এসব বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে পিতামাতার ভরনপোষণ আইন চালু করেন। এ আইনের ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতামাতার ভরনপোষণ দিতে হবে। সন্তান-সংখ্যা বেশি হলে তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নেবেন কে মা-বাবার ভরনপোষণ করবেন সে বিষয়টি।
আইন অনুযায়ী, সন্তানদেরকে মা-বাবার খরচ যেমন দিতে হবে, তেমন তাদের সঙ্গে একত্রে থাকতেও হবে। অনুমতি না নিয়ে তাদের বৃদ্ধ নিবাসে পাঠানো যাবে না।
আইনের ধারা-৫ বলছে, ধারা-৩ অনুযায়ী যে সন্তান পিতামাতার ভরনপোষণসহ তাদের সঙ্গে বসবাসের শর্ত পূরণ করতে পারবেন না তাকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এ জরিমানা পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার তিন থেকে ছ’মাসের জেল হতে পারে।
আইনের ধারা-৭ অনুযায়ী, এর অধীনে দায়েরকৃত মামলাগুলো আপোষযোগ্য এবং জামিনযোগ্য।
মূলত দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা প্রতিষ্ঠাই এ আইনের উদ্দেশ্য। তবে এখানে জামিনের বিধান রয়েছে বলে এ ধরনের মামলাগুলো অনেক দিন ধরে চলে। তাছাড়া আইনটি প্রণয়নের কাজ শেষ হলেও সরকার এখনও এর ধারাগুলো চূড়ান্ত করেনি।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোর্শেদ বললেন, “আইনটা খুব ভালো। তবে সরকার এখনও এটি চূড়ান্ত করেনি। তাই যথাযথভাবে এটি কার্যকরও করা যাচ্ছে না।”