অপুষ্টিতে ভোগেন দেশের দেড় কোটি প্রবীণ
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা দেড় কোটি। দেশের এক-চতুর্থাংশ প্রবীণ অপুষ্টিতে ভুগছেন, বাত-ব্যথায় ভুগছেন ৫২ শতাংশ প্রবীণ। নিরাময় অযোগ্য রোগে আক্রান্ত প্রবীণদের জন্য হোম বেসড প্যালিয়েটিভ সেবা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি পৃথক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার প্রবীণ দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে, গবেষণা তিনটির ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৭.৫ শতাংশই প্রবীণ। তাদের মধ্যে, ২৬ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছেন, এবং ৬২ শতাংশ রয়েছেন অপুষ্টির ঝুঁকিতে।
দেশের প্রবীণেরা কী কী কারণে অপুষ্টিতে ভোগে্ন তা দেখতে ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটি গবেষণা চালায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এ্যাড ইনফরমেটিকস বিভাগ।
প্রবীণদের পুষ্টি অবস্থা সম্পর্কিত বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে রাজধানী ঢাকার উত্তরাখানের তিনটি গ্রামে, ১২৫ জন প্রবীণ ব্যক্তির মাঝে এই গবেষণাটি চালানো হয়েছিল।
"ফ্যাক্টর এসোসিয়েটেড উইথ দ্য নিট্রিশনাল স্টেটাস অফ দ্য ওল্ডার পপুলেশন ইন এ সিলেক্টেড এরিয়া অফ ঢাকা, বাংলাদেশ" শীর্ষক গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে, প্রবীণ জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে বা অপুষ্টির ঝুঁকিতে রয়েছে। এরমধ্যে নারীরা রয়েছে বেশি ঝুঁকিতে; ২২ শতাংশ পুরুষ এবং ২৮.৮ শতাংশ নারী প্রবীণ অপুষ্টিতে ভুগছেন।
গবেষণায় বলা হয়েছে, বিষণ্ণতা, মুখ ও দাঁতের জন্য অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা এবং শিক্ষার অভাব প্রবীণ জনগোষ্ঠীর পুষ্টির মানের সঙ্গে নেতিবাচকভাবে জড়িত।
গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রবীণদের মধ্যে যারা সঙ্গী ছাড়া জীবন কাটাচ্ছেন তাদের মধ্যে অপুষ্টি এবং অপুষ্টির ঝুঁকির মাত্রা ছিল যথাক্রমে ২৮.৬ এবং ৬৫.৩ শতাংশ।
যাদের মানসিক স্বাস্থ্য স্বাভাবিক (১২.৫ শতাংশ) তাদের তুলনায় যারা হতাশাগ্রস্ত (৩৯.৩ শতাংশ) তাদের মাঝে অপুষ্টির মাত্রা বেশি দেখা গেছে। এছাড়া যেসব প্রবীণদের মুখ ও দাঁতের স্বাস্থ্য খারাপ তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অপুষ্টিতে ভুগছেন।
চিকিৎসকরা বলেছেন, অপুষ্টিতে ভোগা প্রবীণেরা বিভিন্ন ধরনের পুষ্টি-সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন; যার ফলে তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে পারেন না এবং অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। প্রবীণ ব্যক্তিদের নানা ধরণের জটিলতা এবং পুষ্টি অবস্থার কারণে তাদের দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগার প্রবণতা বেড়ে যায়, যা তাদেরকে আরও অপুষ্টির দিকে ঠেলে দেয় এবং এটি একটি দুষ্টচক্রের মতো চলতে থাকে।
এ গবেষণার প্রধান গবেষক ড. কে এম তৌহিদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অপুষ্টির কারণে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। প্রবীণেরা অপুষ্ট হলে তাদের সংক্রমণ ব্যাধি অনেক বেড়ে যাবে, রোগ থেকে সেরে ওঠার হার কমবে, অন্যের ওপর নির্ভরশীলতাও বাড়বে"।
প্রবীণদের অপুষ্টি দূর করতে পুষ্টি বিষয়ক কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. কে এম তৌহিদুর রহমান।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে নারীদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। নারীদের মধ্যে অপুষ্টিতে ভোগার হার বেশি। পাশাপাশি প্রবীণদের মানসিক ও মুখের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে জোর দিতে হবে। কারণ দাঁত ও মুখ ভালো না থাকায় তারা খেতে পারেনা।
ড. কে এম তৌহিদুর রহমান বলেন, "আমাদের একটা ইন্টারেস্টিং ফাইডিংস হলো প্রেশার বা অন্য রোগ বেড়ে যাবে সেই ভয়ে যারা ডিম, দুধ, মাংস কম খায় তারা অপুষ্টিতে ভুগছেন, এতে তাদের হৃদপিণ্ড ভালো থাকার চেয়ে খারাপ থাকছে। ভালো থাকার জন্য খাবার পরিহার করে সে আরো খারাপ থাকছে। সেজন্য প্রবীণদের সঠিক খাদ্যাভাস নিশ্চিত করতে হবে"।
অপুষ্টির পাশাপাশি প্রবীণদের মধ্যে বাত-ব্যথায় ভোগার হারও অনেক বেশি। বিএসএমএমইউ-এর ইন্টার্নাল মেডিসিন বিভাগের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ৫২ শতাংশ প্রবীণ বাত-ব্যথায় ভুগছেন, যাদের অর্ধেকের বেশি মাঝারি মাত্রায় শারিরীকভাবে অক্ষম।
"প্রিভেলেন্স অফ মাস্কুলোস্কেলেটাল ডিসঅর্ডারস ইন দ্য এল্ডারলি পপুলেশন ইন এ রুরাল কমিউনিটি অফ বাংলাদেশ" শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ৪৩.৪ শতাংশ পুরুষ ও ৫৬.৬ শতাংশ নারী বাত-ব্যথায় ভুগছেন।কোমর এবং হাঁটুর ব্যথা প্রবীণদের সবচেয়ে সাধারণ সমস্যাগুলোর একটি। গবেষণায় দেখা গেছে, হাঁটুর অস্টিওআর্থারাইটিসে ভোগার হার ২৬.৩ শতাংশ।
গবেষণাটি দোহার উপজেলার মোকশেদপুর ইউনিয়নের ৮০০ জন প্রবীণ মানুষের উপর পরিচালিত হয়েছে। গবেষণার সময়কাল ছিল এপ্রিল ২০১৭ থেকে মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত।
গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রায় ৬০ শতাংশ রোগী তাদের বাত ব্যথা নিরাময়ের জন্য স্থানীয় চিকিৎসকদের কাছে গিয়েছেন।
জটিল ও নিরাময় অযোগ্য রোগে আক্রান্তদের জন্য বিশেষ সেবা হলো প্যালিয়েটিভ কেয়ার। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৬ লাখ নিরাময় অযোগ্য বা দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতায় ভোগা রোগীদের জন্য প্যালিয়েটিভ কেয়ার প্রয়োজন।
বিএসএমএমইউ এর ২০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী নিরাময় অযোগ্য রোগীদের বাড়িতে গিয়ে হোমবেসড সেবা প্যালিয়েটিভ সেবা দিচ্ছে বিএসএমএমইউ এর প্যালিয়েটিভ মেডিসিন বিভাগ।
বাংলাদেশে হোম বেসড প্যালিয়েটিভ সেবার মূল্যায়ন করতে অক্টোবর ২০২০ থেকে জুন ২০২১ সাল পর্যন্ত একটি গবেষণা চালায় বিএসএমএমইউ-এর পাবলিক হেলথ এ্যাড ইনফরমেটিকস বিভাগ।
"হোম বেজড প্যালিয়েটিভ কেয়ার ফর ইল পেশেন্টস: অপরচুনিটিস ইন বাংলাদেশ" শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, প্যালিয়েটিভ কেয়ার নেয়া ৬০ শতাংশের বেশি প্রবীণই ক্যান্সার আক্রান্ত। রোগীদের মধ্যে মানসিক সমস্যা ও দুশ্চিন্তার লক্ষণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
গবেষণায় সেবার মান বিশ্লেষণ করে বলা হয়, সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সামাজিক, মানসিক এবং আধ্যাত্বিক যত্নের পাশাপাশি শারিরীক বিষয়ের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। রোগীর যত্ন সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
হোম বেইসড প্যালিয়েটিভ সেবার জন্য নির্দিষ্ট প্রটোকল তৈরি, চিকিৎসকদের প্যালিয়েটিভ কেয়ারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানানো, জনসচেতনতা ও প্রচারের সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণায়।
বিএসএমএমইউ-এর ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, "২০৫০ সালের মধ্যে দেশে প্রবীণের সংখ্যা বেড়ে সাড়ে তিন কোটি হবে। প্রবীণদের হাত নবীনদের শক্ত করে ধরতে হবে। বাংলাদেশ সরকার ইক্যুয়িটি মেইনটেইন করছে। যে যে অবস্থায় হোক, সেটা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কিংবা বয়স্কদের ক্ষেত্রে, কীভাবে তাদের অসুস্থতা কমানো যায় সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যারা আছি, সবাই সব বয়সী রোগীকে সমানভাবে সেবা দিতে চাই"।
এ বছর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের স্লোগান- "ডিজিটাল সমতা সকল বয়সের প্রাপ্যতা" (Digital Equity for All Ages)।
বার্ধক্যকে মানুষের জীবনের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে জাতিসংঘ ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর অক্টোবরের ১ তারিখকে "আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস" হিসেবে উদযাপন করে থাকে।