২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়ায় যেন অনাগ্রহ
পাঁচ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়।
তামাকের চাষ ও ব্যবহার কমাতে চার বছর আগে দুটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সেগুলো এখনো খসড়াতেই আটকে রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অনাগ্রহ, উদ্যোগহীনতা এবং তামাক কোম্পানিগুলোর প্রভাবে নীতি দুটি চূড়ান্ত করা যায়নি।
তামাক নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উদ্যোগ আটকে যাওয়ার পেছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর বর্তমান ও সাবেক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভূমিকা রয়েছে বলেও অনুসন্ধানে দেখা গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর তামাক নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালে গঠন করে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল। ওই সেল ২০১৬ সালে 'জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি' ও পরের বছর 'তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতি'র খসড়া তৈরি করে।
তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতির খসড়ায় স্বল্পমেয়াদে (২০১৭-২০২১) তামাক চাষ পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনতে অন্য ফসল উৎপাদনে কৃষকদের প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা দেওয়া এবং এজন্য জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করার পরিকল্পনা করা হয়।
২০২৬ সাল নাগাদ তামাক চাষ ৫০ শতাংশ কমাতে পাবর্ত্য এলাকায় আদা, হলুদ, মরিচ, কলা, আম ও আনারসসহ বিভিন্ন শস্য ও ফল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং উৎপাদিত ফসল বিক্রিতে কৃষকদের সহায়তা করতে প্রয়োজনীয় 'কৃষক বাজার' স্থাপন এবং ফল ও ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপনের কথাও এতে বলা হয়।
নীতিতে ২০৩১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় তামাক পাতার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়। এজন্য তামাক চাষ থেকে সরতে ঋণ সুবিধাসহ চাষীদের সব ধরনের সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়।
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি ও তামাক চাষ নীতিমালার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০৪০ সালে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। নীতিমালা দুটিও চূড়ান্ত করে শিগগিরই কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
শুরু থেকে প্রায় আড়াই বছর তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের দায়িত্বে ছিলেন রুহুল কুদ্দস। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) তিনি বলেন, 'নীতি দুটি নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শুরুতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া মতামত জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ছিল। পরে দেওয়া সংশোধিত মতামত কার্যত তামাক কোম্পানিগুলোরই পক্ষেই যায়। আমার ধারণা, সিগারেট কোম্পানিগুলোর প্রভাবে কৃষি মন্ত্রণালয় আগের অবস্থান থেকে সরে আসে।'
তিনি বলেন, 'তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় বিধিমালা করার সময় আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং শাখায় তা দেড় বছর আটকে ছিল। তখন ওই শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত এক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার ছেলে-মেয়ে বিএটিবিতে চাকরি করতেন। এই কারণে এটি আটকে ছিল বলে আমার বিশ্বাস।'
রুহুল কুদ্দুস আরও বলেন, '২০১৬ সালে সিগারেটের প্যাকেটের ৫০ ভাগ জুড়ে গ্রাফিকাল হেলথ ওয়ার্নিং চালু করেছি। ওই সময় একজন সাবেক সচিব ও বিএটিবির তৎকালীন পর্ষদ সদস্য আমাকে টেলিফোন করে এটি আরও এক বছর পরে কার্যকর করার অনুরোধ করেছিলেন।'
তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করতে বাংলাদেশ থেকে তামাক রপ্তানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক করা হয়েছিল। দু'বছর আগে তা প্রত্যাহার করে নেয় এনবিআর। এতে তামাক চাষ আরও বেড়েছে বলে মনে করছে তামাক বিরোধী সংগঠনগুলো।
ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোলে (এফসিটিসি) নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনা নিষিদ্ধ করার কথা বলা হলেও এটি মানা হচ্ছে না। তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতির খসড়ায় সিগারেটের প্যাকেটের ৯০ শতাংশ জুড়ে সচিত্র সতর্কবাণী প্রচার করার কথা বলা রয়েছে। এ বিষয়ে এনবিআর তামাক কোম্পানিগুলোর মতামত নিতে বলেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে।
২০১৭ সালে সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক চিঠির প্রেক্ষিতে সচিত্র স্বাস্থ্যবাণী বাস্তবায়নে এক বছর সময় দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে চিঠি দেয় এনবিআর।
২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর এনবিআরের প্রথম সচিব (ভ্যাট পলিসি) হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার স্বাক্ষরিত মতামতে বলা হয়, 'প্যাকেটের ৯০ শতাংশ জুড়ে সতর্কবাণী থাকলে ব্যান্ডরোল বা স্ট্যাম্প লাগানোর ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার।'
এফসিটিসি'তে তামাক সংক্রান্ত নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিগুলোর মতামত না নেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। অথচ বাজেট প্রণয়নের আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তামাক কোম্পানিগুলো সঙ্গে বৈঠক করে থাকে। এর কারণ, সরকারের রাজস্ব আয়ের একটা বড় অংশ আসে তামাক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে।
বিএটিবির বোর্ডে সরকারের আমলারা
সরকারের এলোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী, বিড়ি, সিগারেট, জর্দাসহ তামাক শিল্পের কারখানাগুলো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শিল্প মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এই মন্ত্রণালয়ে যখন যে কর্মকর্তা সচিব হিসেবে এসেছেন, তিনিই হয়েছেন বিএটিবির পরিচালক।
সিগারেটের বাজারের ৮০ শতাংশ দখলে রাখা ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশের (বিএটিবি) বোর্ডে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিবরাও। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিবদেরও উচ্চ সম্মানী দিয়ে বোর্ডের পরিচালক বানায় বিএটিবি।
২০১৯ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিএটিবিতে সরকারের ৯.৬১ ভাগ শেয়ার রয়েছে। এর মধ্যে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের শেয়ার ৫.৮২, সাধারণ বীমা করপোরেশনের ২.৮২, বিডিবিএলের ০.৩৩ ও রাষ্ট্রপতির পদের বিপরীতে ০.৬৪ শতাংশ।
রাষ্ট্রপতির পদের বিপরীতে তামাক কোম্পানিতে শেয়ার থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তামাক বিরোধী সংগঠনগুলো।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিএটিবির বর্তমান ৯ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে বর্তমান শিল্প সচিব ছাড়াও রয়েছেন সাবেক শিল্প সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী, সাবেক কৃষি সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ এবং কর্মসংস্থান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল হোসাইন।
মাসুদ সিদ্দিকী ২০১০ সালে শিল্প সচিব হিসেবে যোগদানের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিএটিবির পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ ২০১২ সালে কৃষি সচিব হওয়ার পরপরই বিএটিবির পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি এখন পল্লী সহায়ক ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
অন্যদিকে, অ্যামচেমের সাবেক সভাপতি এ কে এম আফতাব উল ইসলাম বিএটিবির পরিচালক। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও পরিচালক।
তামাক নিয়ন্ত্রণ: নীতি ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব
তামাক কোম্পানিগুলোর বোর্ডসভায় ব্যবসা সম্প্রসারণে নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এসব সভায় সরকারের সাবেক ও বর্তমান আমলারাও উপস্থিত থাকেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদেরও ভূমিকা থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কারণে সরকারের পক্ষে তামাক বিরোধী নীতি গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও তামাক কোম্পানিগুলোর প্রভাব বাড়ছে।
কোভিড সংক্রমণের শুরুতে সরকারি শাটডাউনের সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে সিগারেট কোম্পানিগুলো বন্ধ রাখতে শিল্প মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় উপস্থিত ছিলেন শিল্পমন্ত্রীও।
যেদিন এই সভা হয়, সেদিনই শিল্প সচিব আবদুল হালিমের সভাপতিত্বে অপর এক সভা থেকে কারখানাগুলো চালু রাখার ঘোষণা আসে। আবদুল হালিম তখন একাধারে শিল্প সচিব এবং বিএটিবির পরিচালক।
এছাড়াও শাটডাউন চলাকালে বিএটিবি ও জাপান টোবাকোর সিগারেট বিনা বাধায় যাতে সারাদেশে সরবরাহ করা যায়, তা নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসকদের চিঠিও দিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোলে তামাক কোম্পানিগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত না করার কথা বলা আছে। এ কারণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় রপ্তানি ট্রফি নীতিমালায় তামাক ও তামাকজাত পণ্যকে পুরস্কারের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেছে।
অথচ শিল্প মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতির শিল্প উন্নয়ন পুরস্কার ও জাতীয় উৎপাদনশীলতা পুরস্কার দিচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলোকে। ২০১৮ সালে এই পুরস্কার পায় বিএটিবি।
বিএটিবির বর্তমান পর্ষদে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন বর্তমান শিল্প সচিব কে এম আলী আজম। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকেই তিনি পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। কোম্পানির বোর্ড সভায় তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয় না। তাই শিল্প সচিব হয়ে বিএটিবির বোর্ডে থাকলে স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
তিনি বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব শিল্প মন্ত্রণালয়ের নয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। দু'বছর আগে তৎকালীণ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিএটিবিতে থাকা সরকারের শেয়ার বিক্রি করে দিতে শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কে এম আলী আজম বলেন, 'চিঠি সম্পর্কে কিছু জানি না। খুঁজে দেখতে হবে।'