উন্নয়নের ছোঁয়া নেই সাতক্ষীরা বিসিক শিল্পনগরীতে, করোনায় উৎপাদন নেমেছে অর্ধেকে
অবকাঠামোগত উন্নয়ন নেই, পানির প্লান্টগুলো নষ্ট, রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, জরাজীর্ণ পরিবেশসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরী।
প্রতিষ্ঠার পর ৩২ বছরেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি শিল্প নগরীতে। অন্যদিকে, করোনাকালীন সময়ে বিসিক শিল্পনগরীতে উৎপাদন কমেছে ৫০ শতাংশ। পূর্বে প্রতি মাসে ১০-১২ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হলেও সেটি এখন কমে দাঁড়িয়েছে চার কোটিতে।
শিল্প মালিকরা বলছেন, অবকাঠামো উন্নয়নসহ সুবিধা বাড়ালে উৎপাদন বাড়বে। করোনায় নিঃস্ব হয়েছে ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে, বিসিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, দেওয়া হচ্ছে প্রণোদনা।
১৯৮৮ সালে সাতক্ষীরা শহরের বিনেরপোতা এলাকায় বেতনা নদীর তীরে পতিত ১৫.৭৫ একর জমির উপর গড়ে উঠে বিসিক শিল্পনগরী। ১৯৯০ সালে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য করা হয় ৯৬টি প্লট। বর্তমানে ৯৪ টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৯ টি শিল্প কারখানাকে। তবে তার মধ্যে চারটি কারখানা বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে। বরাদ্দ দেওয়া প্লটের মধ্যে রয়েছে মাছের রেণু উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, দুগ্ধ শীতলীকরণ প্রতিষ্ঠান, বরফ ফ্যাক্টরি, বেকারী, প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি, প্লাইউড ইন্ডাস্ট্রিসহ নানা প্রতিষ্ঠান।
বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মেসার্স রনি প্লাইউড ইন্ডাষ্ট্রির সত্ত্বাধিকারী জিএম নুরুল ইসলাম রনি জানান, এখানে কোন ব্যবসায়ীরাই ভালো নেই। ২৯টি ফ্যাক্টরীর মধ্যে সম্পূর্ণরুপে চালু রয়েছে চারটি। বাকি, আংশিক চালু রয়েছে ২১টি। চারটি আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে। শ্রমিক রয়েছে চার হাজার। আর করোনাকালীন সময়ে সকল ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। উৎপাদন কমে গেছে। কারোনার পূর্বে মাসে ১০-১২ কোটি টাকার বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন হলেও এখনো হচ্ছে চার কোটি টাকার মতো।
তিনি বলেন, সরকার ব্যবসায়ীদের প্রণোদনার আওতায় আনলেও তার কোন সুবিধা এখানকার ব্যবসায়ীরা পাচ্ছে না। আমার সরকারি হিসেবে এক কোটি ২৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে পাঁচ মাসে। সরকার আমাকে এক কোটি টাকা ৪% সুদে প্রণোদনা দিয়েছে। তবে সেই টাকা তুলতে গিয়ে ইসলামী ব্যাংক ৭২ লাখ টাকা কেঁটে নিয়েছে। কারণ হচ্ছে, ব্যাংক থেকে তোলা আগের ঋণের টাকার সুদ ও লভ্যাংশের টাকা পরিশোধ না করলে প্রণোদনার টাকা উত্তোলন করা যাবে না। সেই শর্তে এটা টাকা কর্তন করে বাকি ২৮ লাখ টাকা দিয়েছে। এই টাকা দিয়ে কিভাবে আমি কারখানা পরিচালনা করবো। এখানকার সকল ব্যবসায়ীরা শতাধিক কোটি টাকা লোকসানের সম্মূখীন হয়েছে।
শিল্প উদ্যোক্তা জিএম নুরুল ইসলাম রনি জানান, করোনার শুরুতে সরকার ঘোষণা দিয়েছিল ব্যাংকে ঋণের টাকায় কোন লাভ দিতে হবে না। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, এমন কোন চিঠি তারা পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, আমাদের মত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের যদি স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ দেয় তবে আমরা টিকে থাকবো না হলে নয়। বড় বড় শিল্প উদ্যোক্তারা ঋণ পাই কিন্তু আমরা পাই না।
সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরীর সমস্যার কথা জানিয়ে মেসার্স সাকিব ফুড এন্ড কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির সত্ত্বাধিকারী আনারুল গাজী জানান, ইন্ডাস্ট্রি করার মত জায়গা এটি নয়। পানির সমস্যা, রাস্তাঘাটের সমস্যা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই পানিতে তলিয়ে যায়, জলাবদ্ধতার কবলে পড়তে হয়। সীমানা প্রাচীর নেই। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ নিলেও কোনো সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় না। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিল্প উদ্যোক্তরা। আমি লাভের মুখ দেখিনি। পেটের তাগিদে করছি তবে শুধু লোকসান আর লোকসান।
বিসমিল্লাহ্ হ্যাচারির সত্ত্বাধিকারী সিরাজুল ইসলাম জানান, বিসিকের পানিতে মাছের উৎপাদন ভালো হয় না। পানিতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। পানির প্লান্টটি নষ্ট। পানি সরবরাহ হয় না। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য রাস্তায় পড়ে থাকে। অনেকে শিল্প মালিকগণ বাধ্য হয়ে নিজ খরচে রাস্তা নির্মাণ করে নিয়েছেন। বিসিক কর্তৃপক্ষকে বারবার বলা সত্ত্বেও এখনো কোন পরিবর্তন হয়নি। প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর পার হলেও উন্নয়নের কোন ছোয়া লাগেনি সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরীতে।
সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরীর পানির প্লান্ট অপারেটর আব্দুর রশিদ জানান, পানির প্লান্টটি অধিকাংশ সময় নষ্ট থাকে। বিভাগীয় অফিসে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হয়ে আসতে অনেক সময় লাগে। অনুমোদন পাওয়ার পর পানির সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে।
সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরীর কর্মকর্তা আনোয়ার উল্লাহ্ জানান, করোনার কারণে গত এপ্রিল মাস থেকে বিসিকের উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমেছে। পূর্বের তুলনায় এখন উৎপাদন ৫০%। বেতনা নদী উঁচু হওয়ার কারণে পানি বেরুতে পারছে না। পানি জমে কারখানাগুলোতে খুব অসুবিধার মধ্যে পড়তে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
সাতক্ষীরা বিসিক শিল্পনগরীর উপ-ব্যবস্থাপক গৌরব দাশ জানান, এখানকার পানি, রাস্তাঘাট, জলাবদ্ধতাসহ নানামুখী সঙ্কটে রয়েছে। ইতোমধ্যে মন্ত্রীপরিষদ বৈঠকে সাতক্ষীরাসহ আটটি শিল্পনগরীর উন্নয়ন নিয়ে প্রজেক্ট পাস হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে দরপত্র আহব্বান করে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ শুরু হবে। এতে ব্যবসায়ীদের যে সকল সমস্যা রয়েছে সেগুলো দূর হবে। তাছাড়া করোনাকালীন সময়ে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। করোনার প্রভাবে এখন উৎপাদনও কমেছে। স্বাভাবিক হয়ে উঠতে সময় লাগবে। ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদের ৪% সুদে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার।