বর্জ্যে রূপ নিয়েছে বাড়ির ছাদের সোলার প্যানেল
সময়টা ২০১৪ সাল। তখনও নগর জীবনে বিদ্যুতের বিভ্রাট এক নিত্যনৈমেত্তিক বিষয়। বিদ্যুতের কিছুটা যেন গৃহস্থালি পর্যায়েও উৎপন্ন হয় সেজন্য পাওয়ার গ্রিডের নতুন সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত দেওয়া হয় বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল বসানোর।
শর্তটি পূরণ করেই রাজধানীর বেইলি রোডে অবস্থিত আবাসিক ভবন বেইলি ব্যালেরিনার মালিকেরা ছাদে সৌরকোষ ধারক (প্যানেল) এবং বিদ্যুৎ সংরক্ষণ ও প্রবাহের দরকারি সরঞ্জাম স্থাপন করেন। মোট খরচা আসে আড়াই লাখ টাকা।
পুরো ব্যবস্থাটিতে আছে ৪৯টি সৌরপ্যানেল, যার উৎপাদন সক্ষমতা ৪.১১ কিলোওয়াট। সেগুলো সব এখন অনাদরে-অবহেলায় অব্যবহৃত পড়ে আছে।
"গ্রিড থেকে বৈদ্যুতিক সংযোগ পাওয়া এখন অনেক সহজ। কখনো বিদ্যুৎ চলে গেলে তার জন্য আছে ভবনের নিজস্ব জেনারেটর। একারণেই, ছাদের সোলার সিস্টেমটি আর প্রয়োজন হয় না," বলছিলেন বেইলি ব্যালেরিনার ফ্ল্যাট মালিক সমিতির মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসাইন।
এভাবেই ঢাকা এবং অন্যান্য বিভাগের নানা এলাকায় ছাদে লাগানো সোলার ব্যবস্থাগুলো বর্তমানে প্রায় ব্যবহার হচ্ছে না বললেই চলে।
ঢাকা ভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎশক্তি বিতরণকারী কোম্পানির সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে বাড়ির ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্পূর্ণ সোলার সিস্টেম আছে ৬১,৬৯৩টি। এগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ৪২ মেগাওয়াট। স্থাপনের মোট খরচ প্রায় ২৫২ কোটি টাকা হলেও, ব্যবহারের অভাবে সেগুলো এখন ইলেকট্রনিক বর্জ্যে (ই-বর্জ্য) রূপ নিয়েছে। সঙ্গে টাকার শ্রাদ্ধ তো আছেই।
বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিন্যিয়েবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, ছাদে বসানো সোলার প্যানেল থেকে প্রতি ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ছয় কোটি টাকা। এরমধ্যে অবশ্য জমির খরচ, সম্পূর্ণ সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বসানো এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের খরচও অন্তর্ভুক্ত।
ঢাকা ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড –ডেসকো'র সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, শুধু গাজীপুরের টঙ্গিতেই বাড়ির ছাদে বসানো ৯০ শতাংশ প্যানেল এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
'ইফেক্টিভনেস অব নেট মিটারিং সিস্টেম ইন ঢাকা সিটি ফর রুফটপ পিভি সিস্টেম' শীর্ষক এ গবেষণায় ৩৫টি বাড়ির ছাদে সোলার সিস্টেম পরীক্ষা করা হয়। এদের মধ্যে সঠিকভাবে ব্যবহারের আওতায় ছিল মাত্র তিন/চারটি, বাকিগুলো বলাই বাহুল্য অব্যবহার আর অযত্নে প্রকৃত উপযোগিতা হারিয়েছে।
এব্যাপারে ডেসকো'র নির্বাহী প্রকোশলী (পরিকল্পনা ও নকশা শাখা) ইঞ্জি. মো. রায়হান মন্ডল টিবিএস'কে বলেন, অনেক ভবনের মালিক গ্রিড থেকে বৈদ্যুতিক সংযোগ পাওয়ার লক্ষ্যে ডেমো (মেকি) সোলার সিস্টেম স্থাপন করেছিলেন। সংযোগ মেলা মাত্রই তারা এর ব্যবহার পরিত্যাগ করেছেন।
"অধিকাংশ ছাদে লাগানো সোলার প্যানেলগুলো কাজ করছিল না বা সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ ইনভার্টারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ধুলার স্তরে ঢেকেছিল প্যানেলগুলো," তিনি যোগ করেন।
এদিকে, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চ (সিইআর) এর সহকারী অধ্যাপক ও পরিচালক চৌধুরী মোঃ শাহরিয়ার আহমেদ টিবিএসকে বলেছেন, শহরাঞ্চলে ছাদে সৌরবিদ্যুত ব্যবস্থা স্থাপন বাধ্যতামূলক করা কোনও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নয়।
সৌরবিদ্যুত্ সিস্টেমের সঞ্চালক ব্যাটারিতে কিছু দিন পরপর চার্জ কমে এবং একসময় তা অকার্যকর পয়ে পড়ে। পুরো ব্যবস্থাটিকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে তখন স্থাপনকারীরা আর এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের চেষ্টাও করেন না, তিনি আরও বলেন।
গত কয়েক বছরে উন্নত হয়েছে মূল গ্রিড ব্যবস্থার:
২০১০ সালে গ্রিড সংযোগ পাওয়ার শর্ত হিসাবে গৃহস্থালি, শিল্প এবং বাণিজ্যিক স্থাপনায় ছাদে সৌরশক্তি উৎপাদন ব্যবস্থা বসানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। দেশের মত উৎপাদিত বিদ্যুৎশক্তিতে নবায়নযোগ্য অংশগ্রহণ বাড়াতেই নেওয়া হয় এ পদক্ষেপ।
বিদ্যমান গাইডলাইন অনুসারে, গৃহস্থালি গ্রাহকদের তাদের নিজ চাহিদার কমপক্ষে ৩ শতাংশ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকতে হবে। ৫০ কিলোওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় এমন শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই সক্ষমতার শর্ত ১০ শতাংশ।
ঢাকা মহানগরে ডেসকো'র আওতাভুক্ত এলাকায় আছে ২৪,৬৯৩ ছাদের সোলার সিস্টেম। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশ্যন কোম্পানির অঞ্চলে এমন ৩৭ হাজার স্থাপনা আছে, এরমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন এলাকাও অন্তর্ভুক্ত।
দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানি বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতায় বিভাগীয় এবং জেলা শহরেও প্রচুর সংখ্যক ছাদে বসানো সোলার সিস্টেম আছে।
যাইহোক, গ্রিড বিদ্যুৎ ব্যবস্থার গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে উন্নতি হওয়ায় সিস্টেমগুলি এখন অতিরিক্ত বোঝায় পরিণত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তি গবেষণা ইনস্টিটিউডের অধ্যাপক ড. সাইফুল হক টিবিএসকে বলেন, গ্রিড আওতাধীন এলাকায় সহজে বিদ্যুৎ সংযোগে সুবিধার কারণে সোলার সিস্টেমগুলো এখন অনাবশ্যক বর্জ্যে রূপ নিয়েছে।
"গ্রিড বিতরণ ব্যবস্থা থেকে লোকেরা প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাওয়ায় এই সিস্টেমগুলি অকেজো এবং অলস হয়ে গেছে," তিনি বলেছিলেন।
"এছাড়া, বেশিরভাগ প্যানেল ঠিকঠাক লাগানো হয়নি। ইদানীং তেমন বিদ্যুৎ সঙ্কটে না ভোগায় মালিকেরাও সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণে উৎসাহী নন," নিজ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সাইফুল হক জানিয়েছেন।
এই অধ্যাপকের মতে, ছাদের সৌর ব্যবস্থাকে কাজে লাগানো গেলে দেশে একটি সন্তোষজনক মাত্রায় নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব।
সাইফুল বলেন, "এটা নিশ্চিত করতে হলে, বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলির পরিবর্তে তৃতীয় কোনো কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিয়মিত সিস্টেমগুলি পরীক্ষা করা উচিত।"
তবে বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর দাবি, ঠিকঠাক কাজ করছে নাকি করছে না তা নজরদারিতে তারা নিয়মিতও এসব প্যানেলের হাল-হকিকত মনিটর করেছে।
ডিপিডিসি'র ইঞ্জি. বিকাশ দেওয়ান বলেন টিবিএস'কে বলেন, "আমাদের সার্ভিস পয়েন্টের আওতাধীন ভোক্তাদের প্রতি আমরা তাদের বাড়ির ছাদের সোলার ব্যবস্থা কাজ করছে কিনা তা নিয়মিত পরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়েছি। এগুলোর বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমাদের মাসিক বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে।"
এব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগের কারিগরি একটি শাখা- পাওয়ার সেল- এর মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জানান, দেশের নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যপূরণেই তারা ছাদে স্থাপনের মডেলটি চালু করেছিলেন।
তবে তার দাবি, মানুষজন ভালো উদ্যোগকে গুরুত্বের সঙ্গে নেননি।
"বিদ্যমান স্থাপনার যেন সঠিক ব্যবহার হয় সেজন্য আমরা এখন নেট মিটারিং ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছি," তিনি যোগ করেন।
নেট মিটারিং পদ্ধতি কি সম্ভাব্য সমাধান?
২০১৮ সালে বাড়ির ছাদের সৌর ব্যবস্থার যথাযথ ব্যবহারের জন্য 'নেট মিটারিং' পদ্ধতির গাইডলাইন সরবরাহ করে বিদ্যুৎ বিভাগ।
নেট মিটারিং পদ্ধতির মাধ্যমে বাড়ির আঙিনার সৌর প্যানেল জাতীয় গ্রিডের সাথে সংযুক্ত হয়। এরফলে সৌর প্যানেলের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হয়। গ্রাহকদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ শেষ হয়ে গেলে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। সোলার প্যানেল থেকে গ্রিড ও গ্রিড থেকে উক্ত বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহের দ্বিমুখী এ ব্যবস্থায় উভয় দিকের বিদ্যুৎ সরবরাহের হিসাব রাখা হয়। মাস শেষে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ব্যবহারের ওপরেই বিদুৎ বিল নির্ধারণ করা হয়।
বাড়ির ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে এ পদ্ধতি, জাতীয় গ্রিডে বিদুৎ সরবরাহের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়।
তবে, সোলার প্যানেলের সাথে জাতীয় গ্রিডের সংযুক্তিকরণের ক্ষেত্রে অর্থায়নের অভাবের কারণে ধীরগতিতে এগোয় উদ্যোগটি।
এ উদ্যোগ নেয়ার ২ বছর পর পুরো দেশজুড়ে ৬টি বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানির অধীনে মাত্র ১,১৫২টি সৌর ব্যবস্থা এ প্রকল্পের আওতায় এসেছে।
ডিপিডিসি ও ডেসকোর সূত্রে জানা গেছে, এ সীমাবদ্ধতার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও নেট মিটারিং পদ্ধতিতে আগ্রহ হারিয়েছে।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) সাবেক সদস্য সিদ্দিক জোবায়ের জানান, অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল নয় এমন নিম্ন ক্ষমতার সোলার প্যানেলগুলো একত্রে একটি ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসা যায়।
৯০ শতাংশ সোলার প্যানেল অকেজো পড়ে থাকার একমাত্র কারণ গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের সমস্যা নয়, নেট মিটারিং পদ্ধতি সম্পর্কে তথ্যের অপর্যাপ্ততাও এর একটি কারণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।