‘আগামীর প্রজন্মকে ইতিহাসের সঙ্গে কানেক্ট করতে টিএসসিকে টিকিয়ে রাখতে হবে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ভেঙে নয়, বরং প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতিহাসের সাথে আগামীর প্রজন্মের সংযোগ তৈরি করতে এটাকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
রোববার রাতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড আয়োজিত "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভেঙ্গে নতুন ভবন: কতটা গ্রহণযোগ্য?" শীর্ষক ই-জেনারেশন টিবিএস কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন আলোচকেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিমন্ডলের একটি প্রাণের জায়গা হলো টিএসসি। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে এটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু।
"টিএসসি এখন শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকের কাছে নয়, সারা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের জায়গা। যে গ্রীক স্থপতি এটা নির্মাণ করেন, তিনিও বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে গ্রামীণ আবহের আদলে শিল্পীর নিপুন হাতে এটাকে একেঁছিলেন।"
তিনি বলেন, "আমি নিজে ১৯৮৫ তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। তখন আমরা এই আন্দোলনকে সাজানোর জন্য যেভাবে টিএসসিকে ব্যবহার করেছি, ঠিক তেমনি এই আন্দোলন থেকে বাঁচার জন্যও টিএসসিকে ব্যবহার করেছি। তখন বাহিরে বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। এই টিএসসিই তখন আমাদের ঠাঁই দিয়েছিল।"
সময়ের সাথে এটার সংস্কারের প্রয়োজন আছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি মনে করিনা এটাকে ভেঙে নতুন করে রুপ দিতে হবে। এটার মূল কাঠামো সংরক্ষণ করে ইতিহাসের সাথে আগামী প্রজন্মের বন্ধন তৈরি করতে হবে।
একান্তই যদি এটার ব্যাপ্তি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়, তাহলে সেটা পরিকল্পনামাফিক করতে হবে বলে মনে করেন এই শিক্ষক নেতা।
স্থপতি ও চিত্রশিল্পী মুস্তফা খালিদ পলাশ বলেন, "বাজার অর্থনীতির প্রভাবে ঢাকা শহরের পুরোনো ভবনগুলোও ভেঙে ফেলা হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের সাথে সাথে ইতিহাসকে কানেক্ট করতে এই স্থাপনাগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে। বৈশিষ্টগুলোকে টিকিয়ে রেখে এডাপটিভ রিইউজের মাধ্যমে এটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সরকারিভাবে এটার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।"
তিনি বলেন, "উন্নয়নের জোয়ারে আমাদের কমলাপুর রেল স্টেশন ভাঙার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পথে। সেখানে টিএসটি ভাঙার কথা সামনে আসায় সবার মধ্যে একধরনের ভয় কাজ করছে। টিএসটি ভাঙবে এটা ভাবাই যায় না। এটা আমাদের রক্তের সাথে মিশে আছে। আমি বুয়েটের ছাত্র হলেও এটা আমার কাছে সাডেন ডেথের মতো মনে হচ্ছে। আশাকরি কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই এই সিদ্ধান্ত নেবেন না।"
টিএসসিকে কেন্দ্র করে সারা দেশে আধুনিক সাংস্কৃতিক চিন্তভাবনা ছড়িয়ে পড়েছে উল্লেখ করে সংগীত শিল্পী পথিক নবী বলেন, "এটাকে কেন্দ্র করে বইমেলার শুরু। একটা সময় দেশের অডিও বাজরের প্রভাবও ছিল এই টিএসসি কেন্দ্রিক। একইভাবে রাজনৈতিক পালাবদল এবং সংঘাতে এই স্থান আমাদের আগলে রাখতে চেয়েছে। সুতরাং এর গুরুত্ব বহুমুখী। টিএসটিকে কোনভাবে গুড়িয়ে দেওয়া যায় না।"
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বাবিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, "পৃথিবীতে অনেক পুরানো শহর আছে। সেখানে প্রতিবছর কনসারভেশনের জন্য আলাদা বরাদ্দ থাকে। আমাদেরও কনসারভেশন এপ্রোচে আগাতে হবে। একটা শহরের কিছু স্থাপনা থাকে যেগুলো একসময় ল্যান্ডমার্ক হয়ে উঠে। সেগুলোকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে সংস্কারের মাধ্যেমে।"
অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, "আমি শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে বলছি, এটাকে সংস্কার করতে হলে খুব বেশি ভাঙ্গাচোরা করা যাবেনা। এর মূল কাঠামো ঠিক রেখে সংস্কার করতে হবে। এটা এমন নয় বুড়িগঙ্গার তীরের কোন প্রতিষ্ঠান, যেটা সংস্কারের জন্য গুড়িয়ে দিতে হবে।"
এদিকে, টিএসসির সার্বিক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের উদ্যোগের বিষয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মতামত জানতে চেয়েছে প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদগুলোর ডিন ও ইনস্টিটিউটগুলোর পরিচালকদের কাছে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও সুপারিশ আগামী ২ জানুয়ারির মধ্যে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়।
টিএসসি চালু হয় ১৯৬২ সালে। এর আগে কয়েক দফা এর সংস্কারের কথা উঠলেও তা আলোচনাতেই থেমে যায়। এর মধ্যে একবার অবশ্য টিএসসির পাশে অবস্থিত সুইমিং পুলকে ভেঙে নয় তলা ভবন নির্মাণের কথা হয়। মুল কাঠামো ঠিক রেখেই সংস্কারের সেই উদ্যোগ পরে আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে টিএসসিকে নতুন করে গড়ার লক্ষ্যে যে আলোচনা হচ্ছে সে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন নোটিশ পাননি বলে জানিয়েছেন টিএসসির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সৈয়দ আলী আকবর। তিনি বলেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরের লোকজন এসে তিনদিন মাপে-ঝোকের কাজ করেছে এই তথ্যটাই আছে। এর বেশি জানা নেই।
উল্লেখ্য, গ্রিক স্থপতি কনস্ট্যান্টিন ডক্সিয়াডেস ষাটের দশকের শুরুতে টিএসসির নকশা করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়।