পুষ্টিতে ভরপুর হাসিখুশি
রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পে কাজের সুবাদে ৮ বছর বাংলাদেশে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এডি বিয়ারনট। এ সময় বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোরের অপুষ্টির বিষয়টি তার নজরে আসে। তিনি এও খেয়াল করেন, এখানকার শিশুরা বিস্কুট, চকলেট, ওয়েফারসহ অল্প দামের প্রচুর প্যাকেটজাত খাবার খায়।
কম দামের এসব খাবারে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো যোগ করে দেওয়া গেলে অপুষ্টির সমস্যা অনেকটাই দূর করা সম্ভব- এডির এমন ভাবনা থেকেই বাজারে আসে 'হাসিখুশি' নামের একটি ব্র্যান্ড। আর এই ব্র্যান্ডের পণ্য তৈরির জন্য ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জে গড়ে তোলা হয় কেয়ার নিউট্রেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
'অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হাসিখুশি' স্লোগান নিয়ে অল্প দামের বিভিন্ন পণ্য বাজারে আনে কেয়ার নিউট্রেশন। এসব পণ্যে ২৪ ধরনের পুষ্টি উপাদান যোগ করা হয় বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব উপাদান আসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে।
শুরুতে পণ্যগুলো জনপ্রিয় করতে খানিকটা সমস্যায় পড়লেও হাসিখুশির সামগ্রীর চাহিদা এখন এতটাই বেড়ে গেছে, নারায়ণগঞ্জের কারখানায় উৎপাদন করে কুলানো যাচ্ছে না। এজন্য কেয়ার নিউট্রেশনকে এখন অন্য কারখানা থেকেও পণ্য উৎপাদন করিয়ে আনতে হয়।
মাসে ৪০ টন উৎপাদন সক্ষমতার কেয়ারের পণ্যের চাহিদা এখন ১৪০ টনের মতো।
খুচরা বিক্রির পাশাপাশি কেয়ার নিউট্রেশনের সঙ্গে এখন যুক্ত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক ক্রেতারাও। কন্ট্রাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের জন্য ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করেছে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি (এসএমসি)।
এসএমসি প্রাথমিকভাবে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ টন পণ্য নেবে কেয়ার নিউট্রেশনের কাছ থেকে। 'সুপারকিড' ব্র্যান্ড নামে এসব পণ্য আলাদাভাবে বাজারজাত করবে এসএমসি।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি) বাংলাদেশের প্রসূতি নারীদের পুষ্টি সাপোর্ট হিসেবে এবং রোহিঙ্গাদের মাঝে এসব পণ্য বিতরণ করবে। শীগগিরই এ নিয়ে কেয়ার নিউট্রেশনের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে ডব্লিউএফপি। বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকও হাসিখুশি ব্র্যান্ডের পণ্য নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে আলোচনা চলছে।
হাসিখুশির পণ্য রপ্তানিরও প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কেয়ার নিউট্রেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এডি বিয়ারনট বলেন, 'পুষ্টিমানে হাসিখুশির পণ্যের স্ট্যান্ডার্ড ঠিক রাখতে আমরা সর্বোচ্চ সতকর্তা অবলম্বন করি। কারণ অনেক বড় প্রতিষ্ঠান এখন আমাদের পণ্য কিনছে এবং কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চলতি বছরেই আমরা রপ্তানি শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছি।'
হাসিখুশি শুরুর গল্প
কম সামে পুষ্টিমান সমৃদ্ধ প্যাকেটজাত স্ন্যাকসজাতীয় খাবার বাজারজাত করার আইডিয়া নিয়ে এডি বিয়ারনট আলোচনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিএসএম নামে বহুজাতিক একটি ভিটামিন ও মিনারেল সবরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
এডির আইডিয়া পছন্দ হয় ডিএসএমের। বিনিয়োগেও আগ্রহী হয় প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাষ্ট্রে বসেই ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে ২০ মিলিয়ন ডলারের একটি ফান্ডও গঠন করা হয়।
এই ফান্ডে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে তোলা হয় ফ্রন্টলাইনার নিউট্রেশন ইনকরপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগেই বাংলাদেশে নিবন্ধিত হয় কেয়ার নিউট্রেশন লিমিটেড।
নারায়ণগঞ্জে কারখানা স্থাপন করে কেয়ার নিউট্রেশন পণ্য উৎপাদনে যায় ২০১৮ সালে। খুলনা দিয়ে শুরু হয় পণ্যের বাজারজাতকরণ। এখন প্রায় সারাদেশেই পাওয়া যায় হাসিখুশির পণ্য। বিক্রি হয় অনলাইনেও।
হাসিখুশি ব্র্যান্ড নামের পাশাপাশি 'নিউট্রি প্লাস' (Nutri+) নামে একটি ব্র্যান্ডেও পণ্য বাজারজাত করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
দুটি পণ্য নিয়ে যাত্রা করে বাজারে শুরুতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি কেয়ার নিউট্রেশন। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার (ফিন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস) মো. মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, 'নতুন পণ্য হওয়ায় শুরুতে মার্কেটিং করাটা কিছুটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিজস্ব উদ্ভাবনের দুটি পণ্য নিয়ে বাজারে আসে হাসিখুশি। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিই, প্রচলিত পণ্যের আদলে পণ্য উৎপাদন ও সেগুলোতে পুষ্টি উপাদান ফর্টিফিকেশনের।'
ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ সম্পর্কে কেয়ার নিউট্রেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এডি বিয়ারনট দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রচলিত অস্বাস্থ্যকর নাশতার বিকল্প হিসেবে নিরাপদ, উপযুক্ত ও সুস্বাদু খাবার বাংলাদেশি পরিবারগুলোর কাছে হাজির করার উদ্দেশে আমরা হাসিখুশি প্রতিষ্ঠা করেছি।'
পুষ্টিতে ভরপুর হাসিখুশি
হাসিখুশি ব্র্যান্ডের যেসব পণ্য এখন বাজারে পাওয়া যায়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বিভিন্ন ধরনের চকলেট বিস্কুট, চকো সিপ, মিল্ক চকোলেট, ওয়েফার, নুডুলস, ড্রিংক পাউডার ও জুস।
প্রতিটি পণ্যে ভিটামিন এ, ডি-৩, ই, বি-১২, বি-২, বি-৬, সি, কে-১ এবং ম্যাগনেসিয়াম, বায়োটিন, ফলিক এসিড, নিয়াসিন, প্যান্টোথেনিক এসিড, থিয়ামিন, ক্যালসিয়াম, কপার, আয়োডিন, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সেলেনিয়াম, জিংক ও সোডিয়াম যোগ করা হয়। পণ্যগুলোও বিক্রি হচ্ছে তুলনামূলক কম দামে।
বাজারে অন্য কোম্পানির সমজাতীয় যেসব পণ্যের দাম ৫ টাকা, হাসিখুশির চকো সিপ, মিল্ক চকলেটও বিক্রি হচ্ছে একই দামে। তবে হাসিখুশীর পণ্যের খাদ্য উপাদানে ২ থেকে ৩ শতাংশ বাড়তি যোগ করা হয় পুষ্টি উপাদান।
মো. মনোয়ারুল ইসলাম বলেন, 'বাজারে প্রচলিত পণ্যের সঙ্গে তুলনা করেই দাম ঠিক করা হয়, যাতে সবাই তা কিনতে পারে। এটাই আমাদের পলিসি।'
পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলেছেন, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা অনুপুষ্টি কণা (যেমন- ভিটামিন, আয়রণ, আয়োডিন, জিঙ্ক ইত্যাদি) খাবারে খুব সামান্য পরিমাণে দরকার হয়। বয়স অনুযায়ী শরীরের যেটুকু মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট দরকার, তা না পেলে অপুষ্টি দেখা দেয়।
পুষ্টিবিদ অধ্যাপক খুরশিদ জাহান বলেন, যারা পুষ্টিহীনতায় ভোগেন, তারা পুষ্টি উপাদানগুলো গ্রহণ করলে কোনো ক্ষতি নেই। তবে যারা নিয়মিত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খান, তাদের বাড়তি পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।
কেয়ারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যারা পুষ্টিহীনতায় ভোগেন, হাসিখুশির পণ্য শুধু তাদের জন্যই। বিশেষভাবে অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশু-কিশোর ও প্রসূতি মায়েদের জন্য।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৩৬ শতাংশই অপুষ্টিতে ভোগে। অপুষ্টির শিকার হয়ে এসব শিশুর ৪৫ শতাংশই মারা যায়।
৩০ হাজার বর্গফুটের কারখানা আরও বড় হচ্ছে
নারায়ণগঞ্জে ৩০ হাজার বর্গফুটের একটি জায়গা লিজ নিয়ে কেয়ার নিউট্রেশন লিমিটেড কারখানা তৈরি করেছে। কারখানার প্রবেশপথে বড় বড় করে লেখা 'হাসিখুশি'।
কারখানার ভেতরে শুরুতেই ল্যাবরেটরি। চকলেট-বিস্কুটের মান ও ফর্মূলা নিয়ে সেখানে চলে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
প্রোডাকশন প্ল্যান্টে ঢুকতে তিন ধাপের হাইজিন প্রটোকল মেইনটেইন করতে হয়। এখানে উৎপাদিত পণ্য প্যাকেটজাত করার আগে আরেক দফা পরীক্ষা হয়।
কেয়ার নিউট্রেশনের কর্মকর্তারা জানান, এখানে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। নিউট্রিয়েন্ট ইনগ্রেডিয়েন্ট যুক্ত করে তৈরি করা কোম্পানিটির প্রথম পণ্য তরল শাহী মালাই। এরপর তৈরি করা হয় ম্যাজিক মিষ্টি। দুই পণ্যই ছিল প্রতিষ্ঠানটির নিজেদের উদ্ভাবন। এরপর প্রতিষ্ঠানটি প্রচলিত বিভিন্ন পণ্যের আদলে নিজস্ব পণ্য উৎপাদন শুরু করে। তাতে নিজস্ব ফর্মুলায় ভিটামিন ও মিনারেল ফর্টিফিকেশন করা হয়।
বর্তমানে কেয়ার নিউট্রেশনের মাসিক উৎপাদন সক্ষমতা ৪০ টন। কিন্তু বাজারে চাহিদা মাসে ১৪০ টনের। বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে নিজস্ব রেসিপিতে অন্য প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এখন কন্ট্রাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিংও করা হচ্ছে। তবে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ার প্রক্রিয়া চলছে।
আইএসও সনদ ও সুইজারল্যান্ড থেকে মান পরীক্ষা
বিভিন্ন পণ্যের মান নির্ধারণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। কিন্তু এ ধরনের খাদ্যপণ্যের মান নির্ধারণের সক্ষমতা নেই বিএসটিআইর।
তবে কারখানার ফুড সেফটি ম্যানেজম্যান্টের জন্য বিএসটিআই থেকে সার্টিফিকেশন নিতে হয়েছে কেয়ার নিউট্রেশনকে। গত বছর খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএসটিআই থেকে আইএসও সনদ পেয়েছে কেয়ার। বলে রাখা ভালো, ফুড সেফটি ম্যানেজমেন্টের জন্য এই সনদ দেওয়া হয়।
বিএসটিআইর ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সার্টিফিকেশন উইংয়ের উপ-পরিচালক মো. নাজির আহম্মদ মিয়া টিবিএসকে বলেন, একটি কারখানার প্রাঙ্গন, মেশিনারিজ, ল্যাবরেটরি, উৎপাদন পরিস্থিতি, হাইজিন, কর্মীদের দক্ষতা, ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মান পূরণ করলেই শুধু আইএসও সনদ দেওয়া হয়।
এই সনদ দিয়েই বাংলাদেশে নিউট্রেশন ড্রিংকস হরলিক্স, বুস্ট, বোর্নভিটা বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি। নাজির আহম্মদ মিয়া আরও বলেন, 'যেসব পণ্যে বিএসটিআইর স্ট্যান্ডার্ড সার্টিফিকেশন দেওয়ার সক্ষমতা নেই, তারা আইএসও সনদ নিয়ে ব্যবসা করতে পারে।'
বিএসটিআইর মান যাচাই সক্ষমতা না থাকলেও কেয়ার নিউট্রেশন নিজেরাই উৎপাদিত পণ্যের মান, পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ ঠিক আছে কি না, তা নিয়মিত যাচাই করে থাকে।
নিয়মিত বিরতিতে সুইজারল্যান্ডের সুইস ভিটামিন ইনস্টিটিউট থেকে পণ্য পরীক্ষা করিয়ে আনে কেয়ার। পাশাপাশি সায়েন্স ল্যাবরেটরি (বিসিএসআইআর) ও বেসরকারি ল্যাব এসজিএসকে দিয়েও পণ্য পরীক্ষা করায় প্রতিষ্ঠানটি।