বাড়ছে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা
'নিঝুম অরণ্যে' চলচ্চিত্রটি প্রযোজকের অনুমতি না নিয়েই ইউটিউবে ছাড়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৯ সালে জি-সিরিজকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কপিরাইট অফিসের ইতিহাসে এটাই প্রথম অর্থদণ্ডের ঘটনা।
একই বছর নাট্য প্রযোজক এফ জামান তাপস ফ্যাক্টর থ্রি সলিউশনের বিরুদ্ধে অনুমতি ছাড়াই তার নাটক প্রচার ও বিক্রির অভিযোগ করলে কপিরাইট আইনে প্রতিষ্ঠানটিকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
এরকম আরো অভিযোগের নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে সংশ্লিষ্টদের আনাগোনা আগের চেয়ে বেড়েছে। বেড়েছে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যাও। ২০১৭ সালে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৭০টি। ৪ বছরের ব্যবধানে ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৬২১টি।
অন্যান্য দেশের তুলনায় এ সংখ্যা নিতান্তই সামান্য হলেও আস্তে আস্তে তা বাড়ছে। সৃজনশীল কর্মে জড়িতরা কপিরাইট সম্পর্কে এখনো তেমন সচেতন নন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে নিজস্ব কাজের মেধাসত্ত্ব সংরক্ষণে তাদের মধ্যে খুব বেশি আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, মেধাসত্ত্ব রক্ষার বিষয়টিকে এখন অনেক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, 'আমাদের কাজের প্রতি মানুষের মানুষের আস্থাও বাড়ছে। তারা মনে করছেন, কপিরাইট অফিসে আসলে সুবিচার পাওয়া যায়।'
১৯৭৪ সালে দেশে প্রথম কপিরাইট আইন চালু হয়। এরপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এর সূত্র ধরে কপিরাইটের আওতায় আসা সৃজনশীল কর্মের ব্যাপ্তিও অনেক বেড়েছে। এসবকে অন্তর্ভুক্ত করে ২০০০ সালে চালু হয় নতুন কপিরাইট আইন। ২০০৫ সালে এই আইনেও কিছু সংশোধন আনা হয়।
বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন, আপিল মামলা নিষ্পত্তিতে সহায়তা, পাইরেসি বন্ধে টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালনা ও ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকে।
সাহিত্য, নাটক, সংগীত, রেকর্ড, শিল্পকর্ম, চলচ্চিত্র, বেতার সম্প্রচার, টেলিভিশন সম্প্রচার, কম্পিউটার সফটওয়্যারসহ বিভিন্ন সৃজনশীল কাজের কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
রেজিস্ট্রেশন সবচেয়ে বেশি চলচ্চিত্রে, সবচেয়ে কম সফটওয়্যারে
কপিরাইট অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র আর সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কপিরাইট আইন লঙ্ঘন হচ্ছে। তবে চলচ্চিত্রেই সবচেয়ে বেশি কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। আইনে চলচ্চিত্র বলতে পূর্ণ ও স্বল্প দৈর্ঘের চলচ্চিত্র, অ্যানিমেটেড ফিল্ম, ডকুমেন্টারি, নাটক, মিউজিক ভিডিও, চলচ্চিত্রের গান, বিজ্ঞাপনচিত্র ইত্যাদিকে বোঝায়।
২০১৮ সালে চলচ্চিত্রে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা ছিল ৩৪২। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩১০। গত বছর তা আরো বেড়ে হয়েছে ১৫২৬।
চলচ্চিত্র পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিনোদনের দেশি-বিদেশি ডিজিটাল প্ল্যার্টফর্মগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেকেই সেখান থেকে ভালো আয়ও করছেন। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কনটেন্টগুলো মিসইউজ হওয়ারও ঝুঁকি রয়েছে। এ কারণে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা বাড়ছে।
সংগীতে ২০১৮ সালে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ১৮৯টি। পরের বছর তা কমে দাঁড়ায় ১০০-এ। গত বছর আবার তা বেড়ে হয়েছে ২১৩।
সচেতনতার অভাবেই সংগীতে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন কম বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গীতিকার, সূরকার ও শিল্পির অনুমতি ছাড়াই দেদারসে গান আপলোড হচ্ছে ইউটিউবসহ বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে। এমনকি গানের দল, ব্যান্ড নিয়েও জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
বাংলা আধুনিক গানের গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কপিরাইট নিয়ে কথা বলতেই ইচ্ছা করে না। আইন থেকে কি লাভ, যদি তার প্রয়োগ না থাকে?'
কম্পিউটার সফটওয়্যার, অ্যাপস, ওয়েবসাইটসহ তথ্যপ্রযুক্তিতে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা সবচেয়ে কম। ২০১৮ সালে এই ক্যাটাগরীতে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ৯৪টি, ২০১৯ সালে ১৫৫টি, ২০২০ সালে ১২০টি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি একেএম ফাহিম মাশরুর টিবিএসকে বলেন, দেশের তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ সফটওয়্যার তৈরি করেছেন, তার ৯০ শতাংশেরই কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন হয়নি। আইনী সুরক্ষা পাওয়া যায় না বলে সফটওয়্যার নির্মাতারা বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না।
বেতার ও টেলিভিশনের সম্প্রচার সত্ত্ব, ও শিল্পকর্মের কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের বিষয়েও সংশ্লিষ্টদের আগ্রহ খুবই কম। এসব ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন সংখ্যা নেহায়েতই নগন্য।
সাহিত্যে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের আগ্রহ বাড়ছে
কপিরাইট অফিস থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, সাহিত্যে কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি বাড়ছে। ২০১৮ সালে সাহিত্যে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ৫৩২টি, পরের বছর ৬১১। আর গত বছর তা আরো বেড়ে হয়েছে ৭০০টি।
সময় প্রকাশনের মালিক ফরিদ আহমেদ এ ব্যাপারে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সৃজনশীল মানুষদের একটা বড় অংশই কপিরাইটের বিষয়ে সচেতন নন। বিক্রি বেশি হয় এমন বই লেখকের সংখ্যাও দেশে কম। ফলে বইয়ের পাইরেসি খুব একটা হয়না। লেখকরা বিপদে পড়লেই কেবল কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের মর্ম বোঝে।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন মনে করেন, সাহিত্যে প্রতিবছর যে পরিমাণ কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন হয়, তা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। এ ব্যাপারে লেখকদের আরো সচেতন হওয়া উচিত। প্রকাশকদের উচিত নবীন বা প্রবীণ- সব ধরনের লেখকের বইয়ের কপিরাইটের বিষয়টিকে সমান গুরুত্ব দেয়া।
পাঁচ বছর আগে পাইরেসি বন্ধে কপিরাইট অফিস একটি টাস্কফোর্স গঠন করলেও এখন পর্যন্ত কোনো অভিযান পরিচালনা করে নি তারা। এ বিষয়ে কপিরাইট পরিদর্শক মো. আতিকুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'লিখিত অভিযোগ না করলে আমরা কোনো অভিযান পরিচালনা করতে পারি না। ৫ বছরের আমাদের কাছে কাছে কেউ লিখিত কোনো অভিযোগ করেনি।'
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Now many move to protect their intellectual property