রাজনৈতিক নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প ও অর্থনৈতিক নেতা শি জিনপিংয়ের মধ্যে পার্থক্য এখানেই
সারা পৃথিবীতে ট্রাম্পের বিদায় নিয়ে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশও এ আলোচনায় পিছিয়ে নেই। ট্রাম্প এখন একটি প্রতীক। কারণ, গত পাঁচ বছর ধরে যেসব কর্মকান্ডের নজির তিনি রেখে গেছেন, তা ছিল "গণতন্ত্র বিরোধী"। এমনকি তাঁর দেশের তথাকথিত যে ঐতিহ্য আছে, তিনি তারও বিরোধী। তার বিদায়কে ভাবা হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিজয়।
ট্রাম্পের রাজনীতি নিয়ে যে পরিমাণ আগ্রহ-উত্তেজনা বাংলাদেশে তৈরী হয়েছে- তা অদ্ভূত। কারণ, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক খুবই সীমিত। যেটুকু রয়েছে তা হলো অভিবাসনকে ঘিরে। কারণ, অভিবাসনের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের নেয়া নীতিগুলো সত্যিই কঠোর ছিল। কিন্তু, এই একটি কারণেই ট্রাম্পকে ঘিরে বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষের এতটা আগ্রহ থাকার কথা নয়।
এর কারণ হলো, বাংলাদেশের মানুষ; ধনী বা গরীব, যে যা-ই হোক না কেনো, তারা মনে করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো গণতন্ত্রের প্রধান শক্তি। 'স্ট্যাচু অব লিবার্টি' যেমন স্বাধীনতার মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তেমন গণতন্ত্রের মশাল ধরে রেখেছে। এই ধারণা কেবল বাংলাদেশে নয়, অন্যান্য অনেক দেশেই প্রতিষ্ঠিত।
প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য আমরা মুহুর্তের মাঝেই খবর পেয়ে যাচ্ছি। আর এসব কারণেই বোধহয় বাংলাদেশের মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি নিয়ে এতটা আগ্রহী। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাঝে এই মার্কিন পূজো অনেক বেশি দেখা যায়। যেহেতু "গণতন্ত্র" নিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর আবেগটাই একটু বেশি।
দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আমাদের বুদ্ধিজীবী, বড় বড় ব্যক্তিত্বরা এ নিয়ে অসংখ্য লেখালেখি করছেন, টক শো করছেন এবং মতামত দিচ্ছেন। মার্কিনদের গণতন্ত্র রাজনীতি নিয়ে তারা যতটা ভেবেছেন- ততোটা বোধহয় নিজের দেশকে নিয়েও তারা কস্মিনকালে ভাবেননি।
কিন্তু তারা যা মনে রাখেন না তা হলো; নিজের দেশে মার্কিনি গণতন্ত্র বজায় রাখতে সারা দুনিয়ায় কি কান্ডটা করেছে এই দেশ। সেদিক থেকে ট্রাম্প যে কাজটা করতে সফল হয়েছেন; তা হচ্ছে মার্কিন ভাবমূর্তির পুনরুদ্ধার। মার্কিন গণতন্ত্রের প্রশংসায় বাংলাদেশের মিডিয়া সয়লাব। সবাই এখন মার্কিন ভক্ত, ট্রাম্পকে ধন্যবাদ।
অর্থনীতি বনাম রাজনীতি: দ্বন্দ্বের নতুন স্তর
সবার মনে আছে কিনা জানি না, ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তথা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা ছিল। যা ছিল ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দা। চীন সেই মন্দায় চাপা পড়েনি, বরং আরো সবল হয়েছিল। কারণ, তার অর্থনীতি ভঙ্গুর পশ্চিমা অর্থনীতির মতো দুর্বল ও অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিলগ্নি নির্ভর ছিল না।
সেই মন্দা সবাইকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে, চীন ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টিকতে পারবে না। আমি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কলেজে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে ছিলাম। আমার মনে আছে, ঐসময় সবাই বলছিল যদি টিকতে হয়, তবে চীন ছাড়া- তা সম্ভব না।
কিন্তু, বাংলাদেশের মানুষের মার্কিন রাজনীতি নিয়ে এত আবেগ-উৎকণ্ঠা থাকলেও, কেনো এই অর্থনৈতিক বাস্তবতার বিষয়টি তারা স্মরণ করে না, তা আমার জানা নেই।
২০০৮ সাল যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ভাঙনের বছর ছিল, তেমনি ঠিক একই সময়েই চীনের সঙ্গে কমবেশি বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল দেশটি। সে যুদ্ধ এখনো চলমান।
এই কোভিডের সময়ে যখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানের মতো বড় বড় দেশে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে- সেখানে ব্যতিক্রম চীন। ২০২০ সালের অবস্থা অনুসারে বিশ্লেষকদের মতে, বৈশ্বিক জিডিপিতে চীনের অংশীদারিত্ব অংশের পরিমাণ বাড়তে পারে, যা ২০১৯ সালের চেয়ে বেশি। বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশ যাবে কমে।
তাই আমার মনে হয়, আমরা ভুলে যাচ্ছি, রাজনৈতিক নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং অর্থনৈতিক নেতা শিন জিংপিং এরমধ্যে পার্থক্যটা এখানেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে রাজনীতি দিয়ে বিশ্ব শাসন করতে আর চীন চাইছে অর্থনীতি দিয়ে। এই পার্থক্য এখন পুরো পৃথিবীজুড়ে হলেও, আমরা তা আলাদা করতে পারছি না।
ট্রাম্পকে হারালো কে? বাইডেন না চীন?
বছর পাঁচেক আগে ট্রাম্প সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল,সে জিতলে দুনিয়ার কি হাল হতে পারে। আমি বলেছিলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কী হচ্ছে না হচ্ছে- তা এখন চিন্তাভাবনার বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের যে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব চলছে সেটাই বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অর্থনীতিতে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা ছিল চীনের অর্থনীতিকে কাবু করার চেষ্টা, যা সম্ভব হয়নি। সেটা হবে, বিশ্লেষকরাও কেউ আর তা বলছেন না।
গত পাঁচ বছরে কারও যদি অর্থনৈতিক ভাগ্য বৃহৎ হয়ে থাকে- তা হলো চীনের। চীন তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনীতির লড়াইয়ে যাচ্ছে না। চীন বলছে না সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করো, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনো, সে শুধু বলছে ব্যবসা করো। রাজনীতির বদলে অর্থনীতির ওপর জোর দেয়া একটি মৌলিক পরিবর্তন। আমাদের দেশে এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা নেই, হয়তো সেভাবে কারো নজরেও আসেনি।
অর্থনৈতিক না রাজনৈতিক রাষ্ট্র?
পৃথিবীব্যাপী, রাজনৈতিক রাষ্ট্র বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি, তা এখন দূর্বল হয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক শক্তিগুলো সবল হচ্ছে। চীনকে রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা না গেলে্ অর্থনীতির দিক থেকে চীন অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। আর অর্থনৈতিকভাবে এগোনো সম্ভব নয়; যদি না দেশের মানুষ তাদের সরকারকে সহযোগিতা করে।
দুর্নীতি দমনে চীনের যে বিচারব্যবস্থা, তাও এখন আলোচনা-সমালোচনার মুখে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে। কিন্তু চীনারা তাদের নিজস্ব গতিতে চলছে, চীন নিজের মত এগিয়ে যাচ্ছে। বাইরের দেশ তাকে নিয়ে কী বলছে; সেব্যাপারে চীনের মাথাব্যাথা নেই।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, রাজনীতির পেছনেই ছুটছে। যেমন ক'দিন আগেই ক্যাপিটল হিলে যে হামলা হলো; সেটাও ছিল রাজনীতি কেন্দ্রিক রাষ্ট্রের সমস্যা। ফলে তারা পিছিয়ে পড়ছে। কারণ যেসব রাষ্ট্র, রাজনীতিকেন্দ্রিক সেসব রাষ্ট্র এখন ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছে। রাজনীতি দিয়ে দেশের অর্থনীতি আগানো যাবেনা, আর অর্থনীতি না এগোলে; বর্তমান দুনিয়ায় টিকে থাকা দায়। একসময় পারা গেলেও এখন আর তা পারা যাবে না।
তাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই লড়াই, সম্ভবত রাজনৈতিক রাষ্ট্র হিসেবে অন্যতম শেষ লড়াই। কারণ, এরপর যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিয়েতনামের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল, মানুষ সে যুদ্ধকে সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব ভাবলেও, মূলত এটি ছিল বাজার দখলের সশস্ত্র যুদ্ধ। কিন্তু, চীন তা করছে না। সশস্ত্রভাবে বাজারগুলোকে দখল না করে, অর্থনৈতিকভাবে বিশ্ববাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
কিন্তু, এ বিষয়টি নিয়ে যতটা আলোচনা আমাদের করা উচিৎ, আমরা তা করছিনা। এশিয়ার কোনো রাষ্ট্রই তথাকথিত গণতান্ত্রিক পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে না। কিন্তু "গণতন্ত্রের" নামে কতদিন অর্থনৈতিক চাহিদা কম গুরুত্ব পাবে- সেটা বলা যাচ্ছে না।
তবে একটি বিষয় এখন অনেকখানিই পরিষ্কার, আর তা হলো; আগামী দিনগুলো চীনের। কারণ, চীন একটি অর্থনৈতিক রাষ্ট্র।
- লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, কলাম লেখক
- অনুলিখন: রাফিয়া মাহমুদ প্রাত