‘পর্ন-প্যান্ডেমিক’ ভাবছেন আপনার সন্তানকে কখনও স্পর্শ করবে না?
শুধুমাত্র গত কয়েক মাসে সংবাদমাধ্যমের রাডারে ধরা পড়া ধর্ষণ অপরাধের শিরোনামগুলোতে একবার চোখ বোলালে আমাদের সম্যক ধারণা জন্মাবে যে, কোন অমানুষের জঙ্গলে আমরা নির্বিকার বাস করে যাচ্ছি। খবরে আসেনি, এমন আরও অসংখ্য।
কোনো খবর আলোচনার কেন্দ্রে এলেই শুধু আমরা অল্প-বিস্তর কথা বলি, ঘটনার নৃশংসতায় দুর্ভাবনায় পড়ে যাই, বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। কিন্তু তার পরে আবার যেই কে সেই! ধর্ষণের ভয়াবহতায় যে আমরা প্রতিটা দিনই আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তা আমাদের উপলব্ধিতে অনুপস্থিত।
কোনো সংবাদে যখন তরুণ অভিযুক্তদের ছবি দেয়া হয়, তখন আমি মুখগুলো খুব ভালো করে দেখি। অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেয়া বাস্তবতা হলো, ঠিক এমন মুখ রাস্তায় হর-হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়! ঠিক এই চোখগুলোই! দলবেঁধে ঘুরছে, হাসি-ঠাট্টা চলছে, চোখের মধ্যে অদ্ভুত একটা শিকারী দৃষ্টি। কৈশোর বা সদ্য-তারুণ্যের যে সহজাত সতেজ ভাব, চোখের যে স্বচ্ছতা, তা হারিয়ে গেছে তাদের। এই ছেলেগুলোর অনেকেই যে একই মাত্রার অপরাধী হওয়ার সম্ভাবনা ধারণ করে, এতে সন্দেহ নেই। দুটি বিধ্বংসী প্রভাব ইতোমধ্যেই তাদের অপরাধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।
এক, নিজের বাড়িতে ও আশপাশের সমাজে নারীদের প্রতি সদা-বিদ্যমান অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা, শাসন ও নির্যাতনের সংস্কৃতি। এই প্রচলিত আবহ তার মনের গড়নকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে তৈরি করে দেয় একদম শিশুকালে। অনেক ক্ষেত্রেই মাকে বাবার হাতে অত্যাচারিত হতে দেখা তার কাছে স্বাভাবিকতা। বোনের তুলনায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা ছোটবেলাতেই তার মনে গেঁথে দেয়া হয়। নিজের পরিবারের বাইরের বাদ-বাকী মেয়েদেরকে ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখার লাইসেন্স ও প্রশিক্ষণ তাকে সমাজই সাদরে দিয়ে দেয়। নারী তাই তার কাছে ভোগের বা পীড়নের।
দুই, অত্যন্ত কচি, নাজুক বয়সেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পর্নের অবারিত সংস্পর্শ। ক্লাস থ্রি-ফোরের বাচ্চার হাতের নাগালে চলে এসেছে এই ভয়াবহ বস্তু। শিশু-মানসের উপর কী কুৎসিত আগ্রাসন! বন্ধুদের সাথে একজোট হয়ে এই দেখে বড় হতে হতে তারা প্যাক হান্টার মনোবৃত্তি ধারণ করবে, তা প্রায় অবধারিত।
পর্ন-প্যান্ডেমিক সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। ভাবছেন আপনার সন্তানকে কখনও স্পর্শ করবে না? আবার ভাবুন! সতর্ক হোন। শতভাগ গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না, কিন্তু আপনার সতর্কতা আপনার সন্তানের নাজুক সময়ে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে পারে। এই প্যান্ডেমিক মাস্ক পরে পার করা তো যাবে না, সন্তানের নৈতিক ইম্যুনিটি দরকার পড়বে। আপনি ধর্মমুখী হলে আপনার সন্তানের মধ্যে ধর্মীয়বোধ জোরদার করা দরকার। আর আপনি আস্তিক না হলে, সন্তানের স্বার্থে কীভাবে নৈতিকতা শিক্ষা দিবেন আপনাকে ঠিক করতে হবে।
সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব মজবুত করুন। আপনার ভয়ে সে কিছু গোপন করে যাবে, এমন না হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। তার স্কুলের, খেলার মাঠের, কোচিং সেন্টারের গল্প সে যেন নির্দ্বিধায় আপনার সাথে করতে পারে। তার মনের প্রশ্ন, শংকা, আগ্রহ সে আপনার কাছে যত খোলাখুলি প্রকাশ করতে পারবে, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আপনার জন্য ততই সহজ হবে। আপনি কল্পনাতেও আনতে পারেন না, এমন অনেক কিছু আপনার সন্তানের অজান্তেই তার সামনে প্রকাশিত হয়ে যেতে পারে। তার নবীন মন কিচ্ছু বোঝার আগেই কদর্য, কুৎসিত তার সামনে উন্মোচিত হয়ে যাওয়া এই যুগে খুবই সম্ভাব্য ব্যাপার। সুস্থ সম্পর্কের স্বরূপ তাকে বোঝানোর দায়িত্ব আপনারই। যৌনতা-সংশ্লিষ্ট ধারণা, শিক্ষা ও মূল্যবোধ আপনি নিজে যদি তাকে দিতে পারেন, এর চাইতে শ্রেয় আর কিছু হতে পারে না।
পর্ন ইন্ডাস্ট্রির মতো শক্তিশালী খুব বেশি কিছু দুনিয়ায় নেই। আর এই বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর কোন কোনাই এর থেকে নিরাপদ নেই। এক সময় প্রবাসী মা-বাবারা সন্তানের কৈশোর-কালে দেশে ফিরে আসতেন, দেশের সমাজ তাঁদের দৃষ্টিতে পশ্চিমা দুনিয়ার চাইতে নৈতিক ও নিরাপদ মনে হতো। সে যুগ বাসি হয়ে গেছে! এখন এদেশে একটা সিগারেটের চেয়ে পর্ন সহজলভ্য, চকলেটের চেয়েও ইন্টারনেট সস্তা। পর্নের দুর্দমনীয় প্রসার রোধে কোন ধরণের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে তাই অভিভাবকদের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা জরুরী। বিশ্বাস করুন, এই মহামারী আপনার ঘর থেকে যত দূরে ভাবছেন, তত দূরে আর নেই! সংক্রমিত হতে একটি ক্লিকই যথেষ্ট হতে পারে।
শালীনতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, নৈতিকতা বিষয়ে আলাপ জারী রাখতে হবে অবশ্যই। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে আমাদের প্রত্যেকের। পোশাকের শালীনতা এই দায়বদ্ধতার অংশ। কিন্তু কোন ধর্ষণ ঘটনার প্রেক্ষিতে ভিক্টিমের পোশাক, চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে কথা বলা দয়া করে বন্ধ করুন!
ধর্ষণের পাশে শালীনতার প্রসঙ্গ টানা অতি বিপদজনক। আপনি হয়ত সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আলাপ তুলছেন, কিন্তু আপনি নিজের অজান্তেই একজন হবু-ধর্ষককে উৎসাহিত করার চলমান কালচারে কন্ট্রিবিউট করছেন। সত্যি কথা বলতে, বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিচারে আনলে বাংলাদেশের মেয়েরা তুলনামূলক অনেক শালীন পোশাকই পরে। তবে শালীনতার ধারণা আপেক্ষিক, তাই এ ব্যাপারে ঐকমত্য সম্ভব হয় না। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও বিদ্যমান সামাজিক মূল্যবোধের বিপরীতে অধুনা জনপ্রিয় যে পাশ্চাত্য-প্রভাবিত লাইফ-স্টাইল, তার প্রভাব নিয়ে কথা বলবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে বলাটা পরিহার করতে হবে।
আপনি হয়ত ভাবছেন মেয়ের জীবন আরও সীমাবদ্ধ করার মধ্যেই নিরাপত্তা ও সমাধান নিহিত। কিন্তু একপেশে প্রতিক্রিয়ায় শেষরক্ষা হয় না। মেয়েকে আপনি সতর্ক করবেন, বাস্তবতা বুঝতে শেখাবেন তো বটেই। মেয়েকে আপনি দেখে রাখবেন তো অবশ্যই, কিন্তু সাথে যদি আপনার ছেলেকেও দেখে রাখতে না পারেন বা মনে করেন যে সেটার দরকার নেই, তাহলে শেষ পর্যন্ত আপনার বা অন্য কারোর মেয়ে কিন্তু নিরাপদ নাও থাকতে পারে। মেয়েকে নিরাপদ রাখার চেষ্টার পাশাপাশি আপনার ছেলেকেও নিরাপদ রাখতে সচেষ্ট হোন। পুত্র ও কন্যা উভয়ই কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, ইন্টারনেটে কী করছে -- এসবে জোরদার নজরদারি প্রয়োজন। নইলে কেউই আর নিরাপদ থাকতে পারবে না! খেয়াল করবেন যে, স্বামীর সাথে ঘুরতে যাওয়া মেয়েটা ধর্ষিত হচ্ছে, গৃহবধূ নিজ বাড়িতে ধর্ষিত হচ্ছে, মায়ের পাশে ঘুমিয়ে থাকা পাহাড়ি মেয়েটা ধর্ষিত হচ্ছে, নিজ পরিবারের সদস্য দ্বারা শিশু বা কিশোরী মেয়েটি ধর্ষিত হচ্ছে। ধর্ম-বয়স-পোশাকে আলাদা হলেও তাদের সবার মাঝে মিল একটি – কদাকার পৌরুষের অবাধ স্বেচ্ছাচারের বলি তারা প্রত্যেকে।
কখনও কখনও ধর্ষণের কোন খবর নিয়ে আপনার কিশোর পুত্র বা কন্যার সাথে আলাপ করা দরকার। বন্ধুদের আড্ডার পূর্বে আপনার সাথে কথোপকথনেই এ প্রসঙ্গ আসাটা তার জন্য ভালো। আপনার সাথে সরাসরি আলাপে তার মনের অনেক প্রশ্ন উঠে আসবে, সে সমস্যা অনুধাবন করতে পারবে, নিজে সতর্ক হবে এবং ভিক্টিমের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শিখবে। এর মাধ্যমে আপনার প্রতি তার আস্থার সম্পর্কও অধিক মজবুত হবে।
ধর্ষকের চাইতে ধর্ষিতকে নিয়ে কৌতূহল আমাদের সমাজে দৃষ্টিকটু রকম বেশি। আমরা বুঝতে অপারগ যে ভিক্টিমের দিকে আঙ্গুল তুললে ধর্ষণ তরলীকৃত হয়ে যায়। আপনি না চাইলেও অপরাধী কিছুটা দায়মুক্তি পেয়ে যায়। আর হবু-অপরাধী মারাত্মক ভুল ইঙ্গিত ও প্রশ্রয় পায়। যে ছেলেটা দিনরাত পর্ন দেখছে, সে-ই আবার আরেক মেয়ের ছবিতে গিয়ে তার ওড়না নিয়ে কমেন্ট করে! কারণ সমাজ থেকে ছেলেটি সর্বদা এই ধারণা পেয়েছে যে সে নিজে যা-ই করুক, পুরুষ হিসেবে যেকোন নারীর উপর মোরাল পুলিশিং তার এখতিয়ার। উদগ্র শিকারী হিসেবে তাই সে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়, শুধুমাত্র পুরুষ বলে। তার বেঁধে দেয়া সীমানার বাইরে যে নারী পা বাড়াবে, তাকে রেইপ করে 'উচিৎ শিক্ষা' দেয়া দরকার বলেও সে মনে করতে পারে! এক মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষা ফেরত চেয়ে রিট করায় তাকে ফেইসবুকে তারই সহপাঠী কিশোররা ধর্ষণ করার হুমকি দিয়েছে যেমন! কোন মেয়ে সিগারেট খেয়েছে বলে রেইপ করার প্রসঙ্গ আনাটা স্বাভাবিক মনে হয় যেমন!
আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে ধর্ষক তৈরির মূল প্রজনন ক্ষেত্র দুইটি -- সমাজে নারীদের প্রতি বিদ্যমান অশ্রদ্ধা-নির্যাতনের সংস্কৃতি এবং পর্নের অবারিত প্রসার। এই দুই প্রভাবে যে বিস্ফোরণোন্মুখ উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়, সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে না পারলে ধর্ষণের বাম্পার ফলন সামাজিকভাবে প্রতিহত করা অসম্ভব হবে।
- লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়