ভুট্টা প্রজনন বীজ উৎপাদন কম, আমদানি নির্ভরতা থেকেই যাচ্ছে
প্রতিষ্ঠার লগ্ন থেকে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউটে ভুট্টার ১৯টি হাইব্রীড ও ৯টি কম্পোজিট ভুট্টার জাত অবমুক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে উৎপাদন বৃদ্ধি ও লাভজনক ফসল হওয়ায় দেশে প্রতি বছরই বাড়ছে ভুট্টার আবাদ, ফলে কমছে আমদানি নির্ভরতা। গত ২০০৯ সালেও যেখানে ভুট্টার আবাদ হয়েছিল এক লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে আর উৎপাদন হয়েছিল ১১ লাখ ৩৭ হাজার মে.টন সেখানে ১১ বছরের ব্যবধানে গত ২০২০ সালে দেশে আবাদ বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে আর উৎপাদন হয়েছে ৫৪ লাখ ২ হাজার মে.টন। তবে আবাদি জমির পরিমাণ ও ফসল উৎপাদন বাড়লেও ভুট্টা আবাদে যে পরিমাণে বীজের চাহিদা রয়েছে তার সিংহভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে প্রয়োজন প্রজনন বীজ উৎপাদনে সক্ষমতা। এজন্য প্রয়োজনীয় জমির অভাব দূর করা অত্যাবশ্যক।
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউট সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধীনে গম গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। ১৯৯৮ সালে তৎকালীণ ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুরে এক জনসভায় গম গবেষণা কেন্দ্রকে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউটে উন্নীতকরণের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১৭ সালে 'বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৭' মহান জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে। এর প্রধান কার্যালয় দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলার নশিপুরে অবস্থিত। সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির অধীন ৫টি আঞ্চলিক কেন্দ্র, ২টি বীজ উৎপাদন কেন্দ্র, ১৪ টি বিভাগ ও ১০টি শাখা রয়েছে।
সূত্রটি বলছে, গত ২০১৯-২০ অর্থ বছরে দেশে ভুট্টার চাহিদা ছিল ৬৫ লাখ টন যার মধ্যে ৫ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়ে দেশে উৎপাদন হয়েছে ৫৪.০২ লাখ টন। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে বিদেশ থেকে ভুট্টা আমদানি করতে হয়েছে প্রায় ১১ লাখ টন। দেশে যে পরিমাণে ভুট্টা আবাদ হয় তার জন্য বীজ প্রয়োজন হয় প্রায় ৬৫ হাজার টন। কিন্তু বাংলাদেশে ভুট্টার বীজ উৎপাদন হয় মাত্র ৪শ' টন। অর্থাৎ চাহিদার ৯৯ শতাংশ বীজই আমদানি করতে হয়। অর্থাৎ ওই অর্থবছরে ১১ লাখ টন ভুট্টা ও ৬৪ হাজার ৬শ' টন বীজ আমদানি করতে হয়েছে। গবেষণা কেন্দ্রটি আগামী ১০ বছরের কর্মপরিকল্পনায় ২০২৯-৩০ অর্থ বছরের মধ্যে ৭ লাখ ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৭৬ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে এখন যেখানে প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হচ্ছে ৯.৭৪ টন সেখানে এই ফলন বৃদ্ধি করা হবে হেক্টর প্রতি ১০.৫০ টনে। শুধু তাই নয়, আগামী দিনে ভিটামিন এ ও প্রো-ভিটামিন সমৃদ্ধ কর্ণ ওয়েল, কর্ণফ্লেক্স, কর্ণ মিল্ক, বেবি কর্ণ, সুইট কর্ণসহ বিভিন্ন হাইব্রীড জাতের ভুট্টা ব্যবহৃত হবে মানুষের খাদ্য হিসেবে। এ লক্ষ্যে কাজ করছেন বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা। ১৯৮৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত তারা ভুট্টার ১৯টি হাইব্রীড ও ৯টি কম্পোজিট ভুট্টার জাত অবমুক্ত করেছে। তবে মাত্র ৫০ একর জমিতে পরপরাগী এই ফসলের জাত সম্প্রসারনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রজনন বীজ সরবরাহ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা। বর্তমানে এখান থেকে প্রতি বছরে ভুট্টার প্রায় ৪০০ মে.টন প্রজনন বীজ উৎপাদন করা হয়। তবে আগামী ১০ বছরের যে কর্মপরিকল্পনা ধরা হয়েছে তাতে করে ভুট্টার জন্য ৪ হাজার মে.টন প্রজনন বীজ উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। এজন্য ভুট্টার জন্য জমি প্রয়োজন প্রায় ২০০ একর।
বর্তমানে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউটে যেসব ভুট্টার জাত অবমুক্ত করা হয়েছে সেসব জাতের ভুট্টা যেমন উৎপাদনে ভাল তেমনিভাবে এসব বীজের মূল্যও কম। তবে চাহিদামাফিক দেশীয় উন্নতমানের বীজ না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে কৃষকদের।
নশিপুর এলাকার কৃষক সহিদুর ইসলাম বলেন, 'আমি গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে প্রতি বছরই ভুট্টার বীজ পাই। এখানকার উৎপাদিত বীজের ফলন ভাল হয়। কিন্তু চাহিদার তুলনায় বীজ পাওয়া যায় না। এখানে কখনো কখনো বিনামূল্যে বীজ দেয়া হয়। আবার কেজি প্রতি বিক্রি হলেও টাকা কম লাগে। বিদেশ থেকে যেসব বীজ ক্রয় করে সেগুলোর ফলনও কম হয়, আবার অনেক সময় কম গজায়'।
একই এলাকার কৃষক আইয়ুব আলী বলেন,'দেশীয় বীজের ফলন বেশি তাই লাভবান হই বেশি। তবে দেশীয় বীজের চাহিদা বেশি থাকায় বীজের বেশ সংকট। তাই বিদেশ থেকেই যেসব বীজ আসে সেসব ক্রয় করতে হয়'।
আব্দুর রহিম বলেন, 'আমি ৫ বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছি, কিন্তু দেশীয় বীজ পেয়েছি মাত্র এক বিঘা জমির জন্য। বাকী ৪ বিঘা জমির জন্য বিদেশ থেকে আসা বীজ ক্রয় করে রোপন করতে হয়েছে। তবে সেসব বীজ কম গজিয়েছে। যদি দেশীয় বেশি বীজ পেতাম তাহলে ফলনও বাড়তো আবার অর্থও কম ব্যয় হতো'।
তপন রায় বলেন, 'বাজারের বীজ ফলন কম, গজিয়েছেও কম। দেশের বীজের গাছ ছোট ও মোচা বড়। বিদেশের ভুট্টার মোচা একই রকম হলেও গাছ বড়, যাতে করে পড়ে গিয়ে নষ্ট হয়। দেশীয় বীজের কেজি ১২০-১৫০ টাকা আর বিদেশ থেকে আসা বীজের মূল্য ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা'।
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউটের ভুট্টা প্রজননবিদ আসগার আহমেদ বলেন, 'ভুট্টা পরপরাগি ফসল এজন্য প্রতিটি জাতের গবেষণার জন্য ৩টি লোকেশন প্রয়োজন। প্রতি বছরে আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হয়। আমাদের জায়গা বাড়ছে না, কিন্তু হাইব্রিডের জাত উদ্ভাবন গবেষণার জন্য জায়গার প্রয়োজন হচ্ছে। এজন্য প্রতিটি জাতের গবেষণায় এক থেকে দেড়মাস করে গ্যাপ দিতে হচ্ছে, কারন পরপরাগির জন্য। কিন্তু দেরী করে যেসব ভুট্টা রোপন করা হচ্ছে সেগুলোতে বৃষ্টির আক্রমণ, পোকা-মাকড়ের প্রাদুর্ভাবের ফলে গুনগত মান ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রতি বছরে হাইব্রিড ভুট্টার বীজের চাহিদা বাড়ছে। প্রতি বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। কিন্তু চাহিদা পূরণ করতে বিদেশ থেকে বীজ আমদানি করতে হচ্ছে। যদি জায়গা বাড়ে তাহলে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় প্রজনন বীজ বিএডিসিকে সরবরাহ করা যাবে যাতে করে এসব জাত সম্প্রসারিত হবে এবং আমাদের সক্ষমতা পূরনে সহায়তা করবে'।
এই প্রতিষ্ঠানের উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোস্তাফিজুর রহমান শাহ বলেন, 'গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রজনন বীজ উৎপাদন এবং সরকারী প্রতিষ্ঠান ও কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা। আমরা নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করছি। এখানে মাত্র ৫০ একর জমি রয়েছে যেখানে গম ও ভুট্টার প্রজনন বীজ উৎপাদন করতে হয়। এখানে জমির অত্যন্ত সংকট। ভুট্টা অত্যন্ত পরপরাগি ফসল হওয়ায় একটি জমি থেকে অপর জমির দুরত্ব ৫০০ মিটার হওয়া উচিত না হলে পরপরাগায়ন হয়ে যায়। আমাদের প্রজনন বীজ উৎপাদন করতে অনেক সমস্যা। দেশে যে পরিমাণে প্রজনন বীজ প্রয়োজন তার মাত্র ৫ শতাংশ চাহিদা আমরা পূরণ করছি। লিজ, অধিগ্রহণ কিংবা অন্য উপায়ে যদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করে এখানে প্রজনন বীজ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায় তাহলে প্রতি বছরে যে বীজ ক্রয় করতে দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে তা হ্রাস করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে সরকার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে'।
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. এছরাইল হোসেন জানান, ভুট্টা অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ফসল এবং এটি আগামী দিনের টিকে থাকার ফসল হবে। আগামীতে অধিক পরিমানে খাদ্যের যোগান হবে এই ফসল থেকে। আগামী ২০২৯-৩০ অর্থবছরের মধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ৭৫-৭৮ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছা যে ভুট্টা যাতে মানুষের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয় অর্থাৎ ভুট্টা থেকে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ কর্ণ ওয়েল, কর্ণফ্লেক্স, কর্ণ মিল্ক, বেবি কর্ণ, সুইট কর্ণসহ বিভিন্ন হাইব্রীড জাতের ভুট্টার জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে সেগুলো থেকে পোল্ট্রি ও ফিডের পাশাপাশি মানুষের খাবার হিসেবে ভুট্টার যোগান থাকবে। এই গবেষণা কেন্দ্র থেকে বেবি কর্ন, সুইট কর্ণ, ভিটামিনএ, প্রো-ভিটামিনসহ বিভিন্নজাতের ভুট্টার বীজ উদ্ভাবন করা হয়েছে। তবে আমাদেরকে এখনও ভুট্টার বীজ বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। যদি এখানে জমির পরিমাণ বাড়ে তাহলে বীজ উৎপাদিত হবে এবং কম দামেই ভুট্টার বীজ সরবরাহ করা যাবে। বিদেশ থেকে আমদানীকৃত বীজের প্রতি কেজির মূল্য ৫ থেকে ৮শ টাকা। অথচ এই প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত ভুট্টার বীজ মাত্র ১২০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি। বীজ উৎপাদন সক্ষমতার অভাবে প্রতি বছর বিদেশে চলে যাচ্ছে প্রচুর অর্থ। আমাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পাশেই সুগার মিলের পড়ে থাকা প্রায় ২০০ একর সরকারী জমি বেসরকারীভাবে লিজ প্রদান করা হয়। যদি সেই জমিই আমাদেরকে লিজ প্রদান করে কিংবা অন্য কোথাও আমাদের জমি লিজ হিসেবে প্রদান করে তাহলে বাংলাদেশে বীজের যোগান দেয়া কিছুটা সম্ভব হতো। ওই পরিমাণে জমি প্রদান করলে প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ প্রজনন বীজ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আর প্রজনন বীজের উৎপাদন বাড়লে বিএডিসিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী বীজ উৎপাদন করতে পারবে। এখানে দেশী বিদেশী প্রশিক্ষিত বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন, শুধু জায়গার সমস্যাটি সমাধান করা হলে বৃহত্তর পরিসরে কৃষকদের সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে।