কাছে দূরে কেবলই নগর, ঘর ভাঙে; গ্রামপতনের শব্দ হয়
আমাদের রূপসী বাংলার কবি সেই কবেই তাঁর কবিতায় গ্রামপতনের আর নগরভাঙার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। প্লাস্টিকে ও পলিথিনে, বর্জ্যে ও বিলবোর্ডে, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও গোঁয়ার্তুমিতে আমাদের অপার ঐশ্বর্যশালী গ্রামগুলোর পতন তো সম্পূর্ণ হয়েছে বহু আগেই, এবার বুঝি শুরু হলো আধুনিকতার জৌলুস আর উন্নয়নের ঢক্কানিনাদের মাঝে সর্বব্যাপী নগরবিনাশের গান!
গেল শতাব্দীর আটের দশকের একেবারে গোড়ার কথা। আমি তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ক্লাসের ফাঁকে কিংবা নানা ছুটিছাটায় বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে দলবেঁধে আড্ডা দেওয়ার প্রিয়তম জায়গা ছিল, আমাদের হোস্টেল থেকে হাঁটাপথের দূরত্বে টিএসসির লাল-সবুজের ছায়াময়, মায়াময় আঙিনাটুকু। কী যে এক অদ্ভুত অমোঘ আকর্ষণ ছিল এই অপূর্ব, সুন্দর স্থাপনাটির; তার সেই লাল ইটের জালিকাটা দেয়াল, দোচালা ঘরের মতো বাঁকানো, ঢালু ছাদঅলা মিলনায়তন, টানা চওড়া বারান্দার চাতাল আর মাঝখানে সেই চোখজুড়ানো ঘাসের গালিচাপাতা চৌকো উঠোন! আর ছিল প্রধান সড়কের ধারঘেঁষে সীমানা দেয়ালের লাগোয়া গোলাকার, স্তম্ভঘেরা ভিন দেশি আদলের একটি ছোট্ট, রহস্যময় স্থাপনা ও মূল ভবনের বাঁদিকের কোণায় একখানা পরিত্যক্ত কুয়ো; যার খবর খুব বেশি কেউ না জানাতে যা হয়ে উঠেছিল আমাদের আড্ডার একফালি নিজস্ব নির্জন পরিসর। কত না স্নিগ্ধ সকাল, নিরিবিলি দুপুর আর ব্যাকুল বিকেল আমাদের কেটেছিল গানে ও গল্পে, প্রেমে ও প্রীতিতে সেই নাগরিক কুয়োর ধারের মোহন মিলনক্ষেত্রে!
তারও আগে, শৈশব ও কৈশোরে, বিদ্যালয়ের বার্ষিক ছুটিতে, সপরিবার ট্রেনে চেপে বেড়াতে আসা হতো রাজধানীতে মামা, খালা আর ফুপুদের বাড়ি। ট্রেন এসে থামত সুন্দর, সুগন্ধি ফলের নামধারী, খাপখোলা গুচ্ছ ছাতা কিংবা এক ঝাঁক উড়ন্ত শ্বেতবকের আদলে তৈরি এক আশ্চর্য, বিস্ময়ভরা সুবিশাল স্টেশনে; ইতোমধ্যেই আমরা যার জগতজোড়া সুনাম ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা জেনে গেছি আমাদের পাঠ্যবই থেকে। বুকভরা গর্ব নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে সার সার সাদা খিলান আর স্তম্ভের ভেতর চারদিক খোলামেলা, হাওয়া-খেলা প্লাটফর্মে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের পা যেন মাটিতে পড়ত না; সুউচ্চ শুভ্র সিলিংয়ের নিচ দিয়ে আমরা যেন প্রায় হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যেতাম স্টেশনের বাইরে অপেক্ষমান হলদে বেবি ট্যাক্সি আর ঘোড়ার গাড়ির আস্তানায়।
ঘটনাচক্রে এই দুটি স্থাপনার স্থপতিই বিদেশি। টিএসসির স্থপতি গ্রিক নাগরিক কনস্তানতিনোস দক্সিয়াদিস, আর কমলাপুর রেলস্টেশনের স্থপতি দুই মার্কিন নাগরিক: ড্যানিয়েল ডানহাম ও রবার্ট বুই। দুটোর নির্মাণকালও প্রায় একই সময়, ষাট দশকের গোড়ার দিকে। অত্যন্ত মেধাবী, বিচক্ষণ এবং স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এই স্থপতিবৃন্দ খুব ভেবেচিন্তে, যত্ন করে স্থাপনা দুটোর যে-নকশা করেন তা যেমন দেখতে খুব শোভন ও সুন্দর, তেমনি ব্যবহার ও উপযোগিতার বিবেচনাতেও ছিল নিখুঁত। সবচেয়ে বড় কথা, এদের নকশা, নির্মাণশৈলী, আঙ্গিক ও স্থাপত্যদর্শন খুবই উন্নতমানের এবং এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে পুরোপুরি অনুধাবন ও আত্মস্থ করে বানানো।
এঁদেরই একজন, ড্যানিয়েল ডানহামের কন্যা ক্যাথরিন ডানহামের সঙ্গে বছর দেড়েক আগে আমাদের সংস্কৃতিকেন্দ্র 'বিস্তার'-এ ঘটনাচক্রে সাক্ষাৎ-পরিচয় হয় আমার। তখন ক্যাথলিনের মুখ থেকেই জেনেছিলাম তাঁর বাবা ও মা দুজনেরই বাংলাদেশের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও মানুষের প্রতি কী গভীর অনুরাগ ও দায়বদ্ধতা ছিল। ড্যানিয়েল ডানহামের স্ত্রী মারি ফ্রান্সেস কবি জসীম উদদীনের অনুপ্রেরণায় বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-ঘাটে ঘুরে ঘুরে এর লোকগানের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থেকে সংগ্রহ করে এনেছিলেন হাজারও জারিগান। পরবর্তীকালে যেগুলো তাঁর ব্যাখ্যা, বিবরণ, টীকাভাষ্য এমনকি স্বরলিপিসহ ইউপিএল থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় 'Jarigan: Muslim Epic Songs of Bangladesh' নামে।
শুধু তা-ই নয়, অনেকেরই হয়তো জানা নেই, নিউইয়র্কবাসী এই মহীয়সী নারী স্বীয় উদ্যোগে আহমদ ছফার 'পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণ' বইটিও ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, তাঁর তৎকালীন সহ-নাগরিক, বন্ধুবর সলিমুল্লাহ খানের সক্রিয় সহযোগিতায়।
পরম বেদনার বিষয়, নতুন রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের বিকাশ ও বেড়ে ওঠার স্মারক, ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী এই দুই স্থাপনাকে নাকি অচিরেই ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে উন্নয়ন, আধুনিকতা ও প্রগতির নামে! আমার কিছুতেই মাথায় আসে না এরকম অদূরদর্শী ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে কীভাবে? বুঝলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকের সংখ্যা এরমধ্যে কয়েকগুণ বেড়েছে, তাই এর আরও বড় পরিসর প্রয়োজন; বুঝলাম কমলাপুর রেলস্টেশনকে মেট্রোরেলের লাইনের সঙ্গে যুক্ত করাও দরকার। কিন্তু তার জন্য বর্তমানের অনন্য ও অমূল্য কাঠামো দুটো পুরোপুরি ভেঙে ফেলে, একই জায়গাতে নতুন করে নতুন নকশা ও বৃহত্তর কলেবরে নির্মাণই কি এর একমাত্র বিকল্প?
একজন প্রকৌশলী এবং সংস্কৃতিকর্মী হিসাবে আমার অন্তত তা মনে হয় না। এরজন্য সর্বাগ্রে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল, আমরা এই স্থাপনাগুলোকে সংরক্ষণযোগ্য ঐতিহ্যিক স্থাপনা হিসাবে নীতিগতভাবে স্বীকার করি কি না? যদি করে থাকি, এবং সেটা না করার কোনো বোধগম্য কারণও দেখি না আমরা, তাহলে তো আমাদের পরবর্তী করণীয় ছিল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসা: যাদের মধ্যে থাকবেন স্থপতি, প্রকৌশলী, নগরপরিকল্পক, পরিবেশবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী প্রমুখ এবং বিশেষ করে টিএসসির ক্ষেত্রে, অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের প্রতিনিধিবৃন্দ। সঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে দুয়েকটি গণশুনানিও।
সেসব কি করেছি আমরা? আমার জানামতে, না। কিন্তু সেটা ঠিকঠাক করা গেলে আমি নিশ্চিত, পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা, বুদ্ধি-বিনিময়, প্রয়োজনীয় জরিপ, সমীক্ষা ও গবেষণার ফলে বেরিয়ে আসত আরও ভালো ও উন্নততর কোনো বিকল্প।
সমস্যাটা আসলে আমাদের রাজনীতিবিদ, আমলাতন্ত্র আর নীতিনির্ধারকদের অগ্রাধিকারবোধ ও মানসিকতার। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ, সংস্কৃতি, প্রকৃতি, পরিবেশ ইত্যাদির বিষয়ে তাঁদের দায় ও আনুগত্যের ঘাটতি থাকার কারণেই তাঁরা দ্রুত ও সহজতর সমাধানের পথটা বেছে নেতে প্রলুব্ধ হন বরাবর। তার ওপর বৃহৎ কলেবরের চটজলদি দৃশ্যমান, চাকচিক্যময়, বিলাসবহুল উন্নয়ন ও উপরকাঠামো নির্মাণের নানাবিধ প্রলোভন তো রয়েছেই। আর সে কারণেই এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে অহরহ।
কদিন আগেই তো যশোহর সাহিত্য পরিষদের প্রাচীন একটি স্থাপনা গুড়িয়ে দেওয়া হলো; তার আগে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খামারবাড়ি এলাকার বহু পুরনো নান্দনিক কৃষিভবনটিও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। চট্টগ্রামের স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, নেলী সেনগুপ্তার স্মৃতিধন্য পারিবারিক বাড়িটি এই তো সেদিন আংশিক ক্ষতির শিকার হয়েও একেবারে শেষ মুহূর্তে বেঁচে গেল অকুতোভয় আইনজীবী রানা দাশগুপ্তের সাহসিকতায়; বুলডোজারের সামনে এসে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার ফলে।
আপনাদের নিশ্চয়ই এ-ও মনে আছে, গেল বছর কুমিল্লার শতবর্ষী বীরচন্দ্র মাণিক্য মিলনায়তন তথা টাউনহলটিও অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল কুমিল্লার সংস্কৃতিকর্মীদের তীব্র প্রতিবাদে এবং আমলাতন্ত্রের নিজেদের সমন্বয়হীনতার সুযোগে।
তবে সময় এখনো একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। আমরা আশা করব, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ প্রশাসনের এই আত্মধ্বংসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে মুখর হবেন এবং সরকারেরও শুভবুদ্ধির উদয় হবে। শত হলেও এই সরকার তথা আওয়ামী লীগই তো তার জন্মের আঁতুরঘর, পুরনো ঢাকার সেই ঐতিহ্যবাহী রোজগার্ডেন নামক সুরম্য অট্টালিকাটিকে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর তাগিদে অধিগ্রহণ করে নিতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রেও তাই সবাই মিলে বসে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে একটা সুন্দর সমাধান নিশ্চয়ই মিলবে, যেখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতা, সংস্কৃতি ও উন্নয়ন, পরিবেশ ও প্রযুক্তির মধ্যে একটি সুষম সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হবে; কেননা গভীরতর অর্থে এই দুইয়ের মধ্যে বড় কোনো বিভেদ কিংবা বিরোধ নেই আদৌ।
এছাড়া, বর্তমান বিশ্বে প্রকৌশল শাস্ত্র ও স্থাপত্যবিদ্যাসংক্রান্ত প্রযুক্তির এমন অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে যে, আলোচ্য স্থাপনা দুটোর বর্তমান নকশা ও নির্মাণশৈলী প্রায় অপরিবর্তিত রেখেই, একই স্থানে কিংবা লাগোয়া জমিতে এর উন্নয়ন, প্রসারণ কিংবা পরিবর্ধনও খুবই সম্ভব। প্রয়োজন শুধু আমাদের মানসিকতার বদল এবং সেইসঙ্গে ঐতিহাসিক, ঐতিহ্যিক স্থাপনাসমূহের সুরক্ষা বিষয়ে একটি প্রকৃত প্রগতিশীল ও গণমুখী নীতিমালা নির্ধারণ, আর তার সঠিক প্রয়োগ ও নজরদারি।
পাশাপাশি আমাদের নেতৃবৃন্দ ও নীতিনির্ধারকদের উন্নয়নভাবনা ও দর্শনের মধ্যেও পরিবর্তন আনা খুব জরুরি; যেখানে মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি, প্রাণপ্রকৃতি ও পরিবেশই থাকবে সকল উন্নয়নের কেন্দ্রে, এবং তা হবে সুষম, সর্বজনীন, সুদূরপ্রসারী, সর্বোপরি কল্যাণমুখী।
পাদটীকা
তবে একটা আশার কথা, সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র অর্থাৎ যাকে আমরা টিএসসি বলে জানি, ওই স্থাপনা ভাঙা হচ্ছে না। এ স্থাপনার মূল কাঠামো না ভেঙে কিছু সংযোজনসহ সংস্কার করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
রোববার (৩১ জানুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে টিএসসি না ভেঙে সংস্কারের নকশা দেখিয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর।
এ নকশায় টিএসসির সামনের ভবনসহ মূল কাঠামোর কোনো পরিবর্তন না করে বর্তমান সুইমিং পুলের জায়গায় ১০তলা বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত নয়; আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি আরেকটি সভায় এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সেখানে কি সিদ্ধান্ত হয়, দেখি!
অন্যদিকে, কমলাপুর নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আশার খবর শুনিনি।
- আলম খোরশেদ: লেখক, অনুবাদক