মেয়ার্স মহাকাব্যে দুঃখিনী বাংলাদেশ
জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের একটু দূরেই বঙ্গোপসাগর। ভালো করে কান পাতলেই শোনা যায় উত্তাল ঢেউয়ের গর্জন। রোববার সাগরপাড়ের এই স্টেডিয়ামে সে আওয়াজ কানে পৌঁছালো না। সাগরিকার এই স্টেডিয়ামে শোনা গেল শুধু ক্যারিবীয় গর্জন, নবাগত এক যোদ্ধার গর্জন। যে গর্জনে ভীত-সন্ত্রস্ত বাংলাদেশ শিবিরে নেমে এলো পিন-পতন নিরবতা। এ যেন শ্মশান বা কোনো মৃত্যুপুরী, যেখানে কাইল মেয়ার্স এক যমদূতের নাম।
ক্রিকেটকে বলা হয় গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। সেই অনিশ্চয়তার প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে রোমাঞ্চ। যে রোমাঞ্চে কেউ ট্র্যাজিক হিরো তো আবার কেউ রূপকথার রাজকুমার। চট্টগ্রাম টেস্টে মেহেদী হাসান মিরাজ, মুমিনুল হকরা যদি হন ট্র্যাজিক হিরো, তবে কাইল মেয়ার্স রূপকথার রাজকুমার।
ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই নায়ক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। অভিষেক ইনিংসেই অনেক রেকর্ড পায়ে লুটিয়ে দলকে ঐতিহাসিক জয় এনে দিলেন মেয়ার্স। তার ২১০ রানের মহাকাব্যিক ইনিংসে চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশকে ৩ উইকেটে হারালো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ঝুলিতে জমা হলো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ৬০ পয়েন্ট। বাংলাদেশের কাছে যা এখনও সোনার হরিণ!
অনিন্দ সুন্দর, অসাধারণ কিংবা অবিশ্বাস্য; এমন শত শব্দেও বাধার উপায় নেই চট্টগ্রাম টেস্টের রোমাঞ্চকে। পঞ্চম দিনে যে রোমাঞ্চ ছড়িয়ে চট্টগ্রাম টেস্ট জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সেই রোমাঞ্চের সবটাজুড়ে একটিই নাম, কাইল মেয়ার্স। চতুর্থ দিন শেষে সবাই হিসাব কষছিল ৭ উইকেট নিতে বাংলাদেশের কতো সময় লাগতে পারে। কিন্তু পঞ্চম দিনে হিসাব গেল উল্টে, মেয়ার্সের ব্যাটিংয়ে উল্টো প্রশ্ন জাগলো, 'জিততে ক্যারিবীয়দের আর কত রান দরকার।'
৩৯৫ রানের বিশাল লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে ৫৯ রান রানেই ৩ উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এনক্রুমাহ বোনারকে সঙ্গে নিয়ে ওখান থেকে দলের হাল ধরেন মেয়ার্স। মেয়ার্সের মতো বোনারও অভিষিক্ত। টেস্টে নবাগত এই সদস্য দলের ক্রান্তিলগ্নে যেন ভুলে গেলেন তারা প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছেন। এ দুজন ১৫.৪ ওভার খেলে চতুর্থ দিনের খেলা শেষ করেন।
পরের দিনটি নতুন, নতুন সূর্যদয়। জাদুর বাক্স নিয়ে মাঠে নামেন মেয়ার্স-বোনার, অবলীলায় পার করে দেন প্রথম সেশন। ৩১ ওভারের প্রথম সেশনে তারা স্কোরকার্ডে যোগ করেন ৮৭ রান। যদিও সেশনটি হতে পারতো অন্যরকম। কিন্তু একটি রিভিউ না নেওয়া ও ৪৯ রানে মেয়ার্সের ক্যাচ মাটিতে ফেলে বাংলাদেশ হারিয়েছে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ, মেয়ার্সকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ইতিহাস গড়ার।
সাদা পোশাকে খেলার অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম, কিন্তু সুযোগ কাজে লাগাতে মেয়ার্স যে অনভিজ্ঞ নন, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। বোনারকে সঙ্গে নিয়ে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দুটি সেঞ্চুরির মালিক মেয়ার্স। দ্বিতীয় সেশনও পার করে দেন এই দুজন, চতুর্থ উইকেট গড়েন ২১৬ রানের জুটি। তাতে ইতিহাসে নাম উঠে যায় মেয়ার্স-বোনারের। দুই অভিষেক ব্যাটসম্যানের ব্যাটে এটা ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের জুটি।
যে স্পিনের কথা শুনলে কাঁপুনি ওঠে ক্যারিবীয় শিবিরে, সেই স্পিন জুজু জয় করে মিরাজ, তাইজুল, নাঈমদের সাবলীলভাবে খেলেছেন মেয়ার্স-বোনার। আরেকটু কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হতে পারতো তাদের, কিন্তু বাঁ ঊরুর চোটের কারণে দ্বিতীয় দিনের পর সাকিব আর হাসান মাঠে না নামায় সেই পরীক্ষা তাদের দিতে হয়নি।
পঞ্চম দিনের দ্বিতীয় সেশন শেষে মাঠ ছাড়ছিল দুই দল। এমন সময়ে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বিদ্যুৎ চলে যায়। যেন বিদ্যুৎ নয়, বাংলাদেশের জ্বলে থাকা জয়ের সম্ভাবনার প্রদীপটিই নিভে যায়। বিদ্যুৎ ফিরতে দেরি হলেও বাংলাদেশ অবশ্য সম্ভাবনার আলো জ্বালাতে দেরি করেনি। তৃতীয় সেশনের প্রথম ওভারেই বোনারকে থামান তাইজুল ইসলাম। ৮৬ রান করা বোনার ফেরায় কিছুটা চাঙ্গা শিবিরে পরিণত হয় বাংলাদেশ।
জার্মেইন ব্ল্যাকউডকে ফেরাতেও সময় লাগেনি। নাঈম হাসানের বলে বোল্ড হয়ে ফেরেন তিনি। এরপর আবারও ক্যারিবীয়দের শাসন। জশুয়া ডি সিলভার সঙ্গে ১০০ রানের জুটি গড়ে তোলেন মেয়ার্স। জয় থেকে ৩ রান দূরে থাকতে আউট হন ২০ রান করা ডা সিলভা। তাতে অবশ্য কোনো প্রভাবই পড়েনি। রূপকথার রাজকুমার মেয়ার্স শেষটা রাঙিয়েছেন। চারদিন বাংলাদেশের দখলে থাকা ম্যাচটিকে একবারের জন্যও মুমিনুলদের দিকে হেলতে দেননি তিনি।
নাঈম হাসানের বলে শেষ রানটি নিয়ে হাওয়ায় চড়ে আকাশে ব্যাট ছোঁড়েন মেয়ার্স। চওড়া হাসিতে উদযাপন বলতে এতটুকুই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাকি ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফরা তখন কড়তালিতে মেয়ার্সকে অভিন্দন জানাচ্ছেন। সারি ধরে নেমে আসছিলেন ড্রেসিং রুম থেকে। সেখানেও দেখা যায়নি বাড়তি কোনো উচ্ছ্বাস। যেন মেয়ার্সের এই কাজটি করেই মাঠ ছাড়ার কথা ছিল!
দলকে রোমাঞ্চকর জয় এনে দেওয়ার পথে ১০০, ১৫০'র পাহাড় পাড়ি দিয়ে সর্বশেষ ২০০ রানে পৌঁছান তিনি। এই ইনিংস দিয়ে ক্যারিবীয় এই অলরাউন্ডার রীতিমতো রেকর্ডের মালা গেঁথেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে অভিষেক টেস্টেই ডাবল সেঞ্চুরির মালিক হয়েছেন তিনি। যা টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের মাত্র ষষ্ঠ ঘটনা। তার আগে পাঁচজন এই কীর্তি গড়েছেন।
চতুর্থ ইনিংসের হিসাবে অবশ্য মেয়ার্সের কোনো সঙ্গী নেই। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে চতুর্থ ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়লেন তিনি। অভিষেক টেস্টের চুতর্থ ইনিংসে এরআগে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি আব্বাস আলী বেগের। ১৯৫৯ সালে ম্যানচেস্টারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১১২ রানের ইনিংস খেলেন ভারতের সাবেক এই ব্যাটসম্যান। ৬২ বছরের পুরনো রেকর্ডটি নিজের করে নিলেন মেয়ার্স।
অভিষেকে ছক্কার রেকর্ডেও নাম উঠেছে মেয়ার্সের। ৭টি ছক্কা মেরে তালিকার দুই নম্বরে উঠে গেছেন ক্যারিবীয় এই ক্রিকেটার। অভিষেকে ৯টি ছক্কা মেরে যে রেকর্ডটি গড়ে রেখেছেন নিউজিল্যান্ডের পেসার টিম সাউদি, তা কোনো ব্যাটসম্যানও এখন পর্যন্ত ভাঙতে পারেননি।
রেকর্ড গড়া ইনিংস দিয়ে দলকে যে জয় এনে দিয়েছেন মেয়ার্স, সেই জয়ে দলেরও অনেক রেকর্ড হয়ে গেছে। ৩৯৫ রান করে ম্যাচ জেতা টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের পঞ্চম সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট ইতিহাসে এটা দ্বিতীয় সফল রান তাড়ার রেকর্ড। টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ডটিও তাদের দখলে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪১৮ রান করে জিতেছিল ক্যারিবীয়রা।
অনেক রেকর্ডের ভীড়ে ক্যারিবীয়দের সবচেয়ে বড় তৃপ্তি হয়তো উপমহাদেশের মাটিতে এমন কীর্তি গড়ায়। এশিয়ায় এটাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড। এরআগে তাদের সর্বোচ্চ রান তাড়া ছিল ২৭৬। সেটাও ৩৪ বছর আগের, ১৯৮৭ সালে দিল্লিতে ভারতের বিপক্ষে। বাংলাদেশের মাটিতেও সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড গড়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আগের সর্বোচ্চ রান তাড়া ৩১৭, নিউজিল্যান্ডের।
জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামকে বলা হয় বাংলাদেশের পয়মন্ত ভেন্যু। এই ভেন্যুতে বাংলাদেশের রেকর্ড অনেক ভেন্যুর চেয়েই উজ্জ্বল। যদিও এই মাঠের সর্বশেষ দুটি ম্যাচ দুঃস্বপ্ন হয়ে রইলো। ২০১৯ সালে জুহুর আহমেদেই ক্রিকেটের নবীন দেশ আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাজেভাবে হেরেছিল বাংলাদেশ। এবার 'দ্বিতীয় সারির' ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও একই অভিজ্ঞতা হলো বাংলাদেশের।
চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশের এই হার অবশ্য অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। ৪৩০ রান করে প্রথম ইনিংসেই মিলেছিল ১৭১ রানের লিড। ব্যাট হাতে সেঞ্চুরির পর বল হাতে ৪ উইকেট নিয়ে ক্যারবীয়দের কোনঠাসা করে রাখেন মেহেদী হাসান মিরাজ। দ্বিতীয় ইনিংসে অধিনায়ক মুমিনুল হকের সেঞ্চুরি ও লিটন দাসের হাফ সেঞ্চুরিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩৯৫ রানের বড় লক্ষ্য দেয় বাংলাদেশ।
ক্যারিবীয়দের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৯ রানে ৩ উইকেট নিয়ে শুরুটাও দাপুটে হয় বাংলাদেশের। সব মিলিয়ে চতুর্থ দিন পর্যন্ত ম্যাচ পুরোপুরি বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু পঞ্চম দিনে গণেশ পাল্টে যেতে সময়ই লাগেনি। নিয়মিত দলের ১৩ জন না থাকায় দ্বিতীয় সারির দল বলে যাদের বিপক্ষে শতভাগ সাফল্য পাওয়ার আশায় ছিল বাংলাদেশ, সেই দলেরই একজন একাই হারিয়ে দিলেন বাংলাদেশকে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের এমন দ্বিতীয় সারির দলের বিপক্ষেই ২০০৯ সালে ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। ১১ বছর পর এসে সেই দ্বিতীয় সারির দলেরই শিকার বাংলাদেশ। কম শক্তির দল নিয়ে ঐতিহাসিক ম্যাচ জিতেও ক্যারিবীয়রা উচ্ছ্বাছে ফেটে পড়ছে না। তবে বিষাদের সুর ঠিকই বেজে যাচ্ছে বাংলাদেশ শিবিরে। মুমিনুল, তামিম, মুশফিকদের হৃদয়ে হয়তো বয়ে যাচ্ছে দুঃখের খরস্রোতা।