মহামারিকালে ভালোবাসা দিবসের ভাবনা
পশ্চিম থেকে আসা ভালোবাসা দিবসে পশ্চিমের জনৈক রায়ানের এই দিবস নিয়ে বিরক্তির বয়ান দিয়ে এই লেখা শুরু করা যাক!
রায়ান বেইলির যদি কোন সঙ্গীনি থেকে থাকত, তবুও তিনি ভালোবাসা দিবসের দিন পাঁচরকম পদের খাবার খেতে বেরোতেন না কিংবা এক বক্স মারজিপানের (এক ধরণের চকলেট আবৃত মিষ্টি) উপর গোলাপ পাঁপড়ি ছড়িয়ে নিয়ে বসতেন না। প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমময় 'ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের' কথাও তিনি ভাবছেন না।
ভালোবাসা দিবস নিয়ে রায়ানের এই বৈরাগ্যের কারণ কি তাহলে? প্রথমত রায়ান বেইলি নিজে রান্না জানেন না এবং তিনি লস অ্যাঞ্জেলসের বাসিন্দা, যেখানে প্রতিনিয়ত করোনা পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে এবং রয়েছে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা। এমতাবস্থায় ১৪ ফেব্রুয়ারি রেস্টুরেন্টগুলোতে কি ঘটবে তা কেউই জানেনা। তাই ৩৯ বছর বয়সী এই অভিনয় শিক্ষকের ভাষ্য, "আমি ভালোবাসা দিবস নিয়ে এই রাজনীতিকরণ পছন্দ করিনা এবং ফসি বলেছেন যে এই মহামারিকালে আমাদের জনসংস্পর্শে থাকা উচিৎ নয়।"
রায়ান এখানেই ক্ষান্ত হননি, তিনি আরও মনে করেন যে এখনই উপযুক্ত সময় এই ভালোবাসা দিবস নামক ক্যাম্পেইনকে বাতিল করা। তিনি মনে করেন এটি এমন একটি দিবস যা মানুষকে আরও মন খারাপ করে দেয়। তিনি একে 'ইনস্টাগ্রাম্যাবল মোমেন্টস' বলে অভিহিত করে বলেন , "মেয়েরা এ দিন চেষ্টা করে তার বান্ধবীদেরকে প্রেমিকের দেয়া উপহার দেখিয়ে মুগ্ধ করতে এবং ছেলেরা চেষ্টায় থাকে কিভাবে মেয়েদের কাছে নিজেকে ভালো প্রমাণ করা যায়।"
গত বারো মাসে সারা পৃথিবীতে যা হয়েছে তা থেকে এটি পরিষ্কার যে মায়া-ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য শুধু ফেব্রুয়ারি মাসের একটি দিনে সীমাবদ্ধ থাকা যথেষ্ট নয়। আমেরিকার গোডিভা চকোলেট কোম্পানি, যাকে একরকম সমার্থক শব্দ মনে করা হয় ভালোবাসা দিবসের, তারাও নিজেদের হৃদয়াকৃতির চকোলেট বক্স গুটিয়ে ফেলেছে এবং নিজেদের ১২৮ টি দোকান বন্ধ ঘোষণা করেছে। মার্চের শেষাবধি এসব দোকান খোলার কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সেই সাথে চকোলেট খাওয়ার জন্যে যে কোন নির্দিষ্ট ছুটির দিন বা উপলক্ষ্য লাগেনা সেটিও আমেরিকার মানুষ বেশ ভালো করেই বুঝিয়ে দিচ্ছে। নি'লসন ডেটা অনুযায়ী, আমেরিকানরা ২০২০ সালে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে চকোলেট কেনার পেছনে যা ১০১৯ এর তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি।
তারপরেও মহামারির কারণে যে 'ভালবাসার বাণিজ্য' ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
এই সময়টাতে আগে ইভেন্ট প্ল্যানাররা নানা অনুসন্ধান করতো যে কেউ বিয়ে বা বাগদান এর পরিকল্পনা করছে কিনা, তাদের মধ্যেও এবার আগ্রহের অভাব দেখা যাচ্ছে।
এখানে বলে রাখা ভালো যে ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি অবাধ দিন, এই দিনটির ভালোবাসা দিবস হয়ে ওঠার পেছনে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো বের করা যায়নি। ব্রাইটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট ও ডিজাইন বিভাগের একজন অধ্যাপক অ্যানাবেল পোলেন এর মতে, এই দিনটি আসলে শুরু হয়েছিল একটি 'সেইন্ট ডে' হিসেবে, যদিও কোন সাধুর দিন তা এখনও নিশ্চিত নয় কেউ।
ড. পোলেন তার পাঠানো ইমেইলে জানান, "ডজন ডজন ভ্যালেন্টাইন নামক খ্রিস্টান শহীদ হয় এবং পরে সাধুত্ব লাভ করে। কিন্তু তেইশ শতকে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনরা বেশি সম্মান লাভ করে মধ্যযুগে এবং সবাইকেই ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।"
সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন এবং ভালোবাসার মধ্যে যোগসূত্র এসেছে ১৪ শতকের দিকে যার সূচনা করেন ইংরেজ কবি জোফ্রে সসার। সসার পাখিদের বসন্তকালীন প্রজনন এর সঙ্গে ভালোবাসা দিবসকে মিলিত করেছেন।
ভ্যালেন্টাইনস ডে'র কালো অধ্যায়
ফুল, চকোলেট ও কিউপিড এর সুন্দর রোমান্স উৎসবের পেছনে ভ্যালেন্টাইনস ডে'র উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে এক কালো, রক্তাক্ত এবং কালিমালিপ্ত অধ্যায়ও।
যদিও সুনির্দিষ্টভাবে যে এই দিবসের উৎপত্তি বের করা যায়নি তা বহুবার বলা হয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে ভালো শুরুটা করা যায় প্রাচীন রোম থেকেই, যেখানে পুরুষেরা নারীদের প্রহার করতো।
১৩-১৪ ফেব্রুয়ারি রোমানরা 'লুপারক্যালিয়া' অনুষ্ঠানের ভোজ পালন করতো। পুরুষেরা একটি ছাগল ও একটি কুকুর বলি দিতো এবং বলির পশুর চামড়া দিয়ে নারীদের চাবুক মারতো। যুবতী নারীরা সেখানে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো এই চাবুকের বাড়ি পাওয়ার জন্যে। তাদের বিশ্বাস ছিল যে এটি তাদেরকে উর্বর করে তুলবে।
এই উৎসবে একটি 'ম্যাচমেকিং' লটারিও হতো যেখান একজন পুরুষ একটি পাত্র থেকে কোনো কাগজ তুলবে এবং কাগজে যে নারীর নাম থাকবে তার সঙ্গেই উৎসবের সময়টা জুড়ে সে একত্রে থাকবে।
আধুনিককালে এই 'ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবস' নামকরণের পেছনেও রয়েছে রোমানদের অবদান। সম্রাট ক্লডিয়াস তৃতীয় শতকের দুটি আলাদা বছরে দুজন পুরুষকে হত্যা করেন, যাদের দুজনের নামই ছিল ভ্যালেন্টাইন এবং দুজনকেই ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ফাঁসি দেয়া হয়। তাদের শহীদ হওয়ার দিনটিকে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালন করার মাধ্যমে সম্মান জানায় ক্যাথলিক চার্চ।
কিন্তু পরবর্তীতে ৫ম শতকে এসে পোপ প্রথম গেলাসিয়াস এই দিনটির উপর কালিমালেপন করেন। তিনি সেইন্ট ভ্যালেনটাইন্স ডে এর সঙ্গে লুপারক্যালিয়া উৎসব এর সমন্বয় করতে যান পৌত্তলিকতা দূর করার উদ্দেশ্যে। কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ নোয়েল লেনস্কির ভাষ্যে, "রোমানরা ছিল তখন নগ্ন ও মদ্যপ জাতি। কিন্তু এই ঘটনাটি মাতাল হওয়াকেও ছাড়িয়ে গেছে, খ্রিস্টানরা একে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে করে এই দিনটির 'উর্বরতা ও প্রেম' এর দিন হয়ে ওঠা আটকানো যায়নি।"
প্রায় একই সময়ে নর্ম্যানরা 'গ্যালাটিন'স ডে' পালন করতে শুরু করে। গ্যালাটিন অর্থ হলো 'একজন নারীর প্রেমিক'। এই অংশটির সাথেই আসলে সেইন্ট ভ্যালেনটাইন্স ডে কে খানিকটা গুলিয়ে ফেলা হয়েছে, যেহেতু এগুলো শুনতে একই শোনায়।
এর পরে শেকসপীয়র তার নানা সাহিত্যকর্মে ভ্যালেনটাইন্স ডে কে রোমান্টিসাইজ করেন, যার ফলে এটি ব্রিটেন এবং সমগ্র ইউরোপজুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
সময়ের সাথে সাথে এই দিনটি আরও মিষ্টি এবং প্রেমময় একটি দিনের প্রতীক হয়ে ওঠে। সসার ও শেকসপীয়রের আবেদনময়ী লেখার ভঙ্গির ফলে তা বিশ্বে নান্দনিক হয়ে দাঁড়ায়। হাতে বানানো কার্ড হয়ে ওঠে 'টোকেনস-ডি-জুর'।
ধীরে ধীরে প্রথাটি বিশ্বে নিজের জায়গা করে নেয়। ১৯ শতকে শিল্প বিপ্লবের ফলে ফ্যাক্টরিতে বানানো কার্ড দেয়ার ধুম পড়ে যায়। ১৯১৩ সালে কানসাস শহরের হলমার্ক কার্ডস তাদের ম্যাস প্রোডিউসিং শুরু করে ভ্যালেন্টাইনসকে কেন্দ্র করে। এর পর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের চেহারাটাই যেন বদলে যায়।
বর্তমানে ভ্যালেনটাইনস ডে এর ছুটির দিনটি একটি বড় ব্যবসায়িক উপলক্ষ। মার্কেট রিসার্চ ফার্ম আইবিআইএস ওয়ার্ল্ড এর হিসাব অনুযায়ী, গত বছর ভ্যালেন্টাইনস ডে'র দিনে বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৭.৬ বিলিয়ন ডলার এবং এবছর তারা সেটি ১৮.৬ বিলিয়ন হবার আশা করছেন।
তবে ভালোবাসা দিবসের এই বাণিজ্যিকীকরণ দিনটিকে নষ্ট করেছে অনেকের জন্য। রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী হেলেন ফিশার যেমন এর জন্যে নিজেদেরই দায়ী করছেন, "আমরা না কিনলে তো হলমার্ক কার্ড টিকেই থাকতো না।"
এখন ভালোবাসা দিবস পালিত হচ্ছে নানা রকম উপায়ে। কেউ কেউ নিজের প্রিয় মানুষের জন্য ব্যাংকের টাকা নিঃশেষ করতে পিছপা হন না, আবার কেউবা 'সিঙ্গেল অ্যাওয়ারনেস ডে' পালন করছেন সেদিন, নিজেই নিজেকে চকোলেট উপহার দিয়ে। কে জানে কেউ হয়তো প্রাচীন রোমানদের উপায়েই পালন করছেন দিনটি! কিন্তু সে প্রসঙ্গ বরং থাক।
আগেপরে যেমনই হোক না কেন, করোনা মহামারির জন্যে এবছরের ভালোবাসা দিবস যে ব্যতিক্রমী হবে তা বলাই বাহুল্য। কেইটলিন কিয়েরনান ও কেনি ক্যাপলান, দুজনেই একসঙ্গে থাকছেন, অন্যান্য বছরে তারা এদিনে সাজগোজ করে দামী ডিনারে বের হলেও এবার তারা সেকথা ভাবছেন না। এর পরিবর্তে তারা পিজ্জা অর্ডার করে বাড়িতে উদযাপন করাটাকেই বেশি ভালো মনে করছেন, সঙ্গে থাকবে এক বোতল ওয়াইন এবং একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করবেন এই মহামারিতেও টিকে থাকার জন্য।
নিউইয়র্কের বাসিন্দা ও মনোবিদ ডা. কার্লি স্নাইডার এর কাছে ভালোবাসা দিবস দিনটিকে খুব একটা খারাপ মনে হয়না। তিনি মনে করেন একদিন একটু বেশি স্নেহ-মায়া দেখাতে পারলে ক্ষতি নেই, কারণ আমরা প্রায়ই নিজের সঙ্গীকে সময় দিতে পারিনা।
কেউ কেউ ভালোবাসা দিবসে উপহার দেয়ার প্রথাকে অপছন্দ করলেও, অনেকে একে মানসিক প্রশান্তির মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। কিছু ফুল, সামান্য উপহার বা চকোলেট দিয়ে যদি কাউকে বিশেষ অনুভব করানো যায় তাহলে তাতে ক্ষতি নেই- এমনটাই সাধারণ মানুষের ভাবনা। বিশেষ করে এই মহামারিকালে নিঃসঙ্গতা দূর করতে বা সুন্দর কিছু সময় পার করার উপলক্ষ হিসেবে ভালোবাসা দিবস দিনটি সম্ভবত একটি সুন্দর ভূমিকা রাখতে পারে।
- এনপিআর অবলম্বনে