রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও গণমাধ্যম
'রাষ্ট্র সার্বভৌম' কথাটার অর্থ কী? বিশ্বব্যাপী এ আলোচনা বহুকালের। রাষ্ট্র চাইলেই কি, যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে? রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদেরকে রাষ্ট্র কি সে অধিকার দিয়েছে? এই বিতর্ক সব সময় আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এমনই একটি বিষয়কে নিষ্পত্তি করেছে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করা হয়েছিল বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ছিল, ফ্রান্স থেকে কেন্দ্রীয় সরকার যে রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছে সেই ক্রয় প্রক্রিয়ার সময় বহু কমিশন লেনদেন হয়েছে। এ বিষয়ে মামলার রিট শুনানির পরে সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল বিষয়টি আদালতের সামনে তুলে ধরার জন্য। সরকার প্রথমে বিষয়টি অবজ্ঞা করার চেষ্টা করেছিল। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে সরকার তার সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সামরিক চুক্তি প্রকাশ না করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু, পরবর্তীকালে আদালতের নির্দেশ সরকার মেনে নিয়েছিল। আদালত তার নির্দেশে বলেছিলেন, 'শুধুমাত্র কোর্টের অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ার জন্যই প্রতিরক্ষা চুক্তিটি বিশ্লেষণ করা হবে এবং তার খুঁটিনাটি বিষয় জনসম্মুখে কাছে প্রকাশ করা হবে না।' এই শর্তের পরই কেন্দ্রীয় সরকার কোর্টের কাছে চুক্তির নানা দিক তুলে ধরে।
প্রশ্ন হল; বিচারিক আদালত কি সর্বজ্ঞানী অর্থাৎ এই সামরিক চুক্তি করার ক্ষেত্রে যে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো থাকে- তা অনেক বেশি টেকনোলজিকাল। এবং অনেক বিষয় থাকে যা কখনো কখনো ব্যবহারকারীদের কাছে কেবলমাত্র প্রকাশ করা হয়-- অর্থাৎ ভারতীয় বায়ুসেনাদের কাছে এই ব্যাপারটাকে তুলে ধরা হবে এবং তারাই হয়তো বিষয়টা সঠিকভাবে জানতে পারবেন। এক্ষেত্রে কোন যুক্তিতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তাদের কাছে যুক্তি বয়ান করতে বলেছিলেন- তা স্পষ্ট নয়। এবং কী পর্যালোচনা করে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, এই চুক্তির ক্ষেত্রে তেমন কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি! পরে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রকাশ করেন যে, চুক্তি করার অধিকার রাষ্ট্রের আছে এবং সততার সাথে প্রয়োজনীয় চুক্তি সম্পাদন করেছে। অভিযোগ ছিল রাফায়েল বিমান ক্রয়ে রিলায়েন্স শিল্পগোষ্ঠীর মুকেশ আম্বানিকে কমিশন দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে, সুপ্রিম কোর্ট চুক্তিটি পর্যালোচনা করে দেখতে পায় যে, ভারতীয় পক্ষে কোনো এজেন্ট নিয়োগ করা হয়নি। রাফায়েল কর্তৃপক্ষ রিলায়েন্সকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করেছিল। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সেই মতামতের পর ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে বিষয়টি নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি।
৭০ বছরের ভারতে এই ক্রয় চুক্তি ছিল, প্রথম কোন সমরাস্ত্র চুক্তি যা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এরপরে আরো বহু চুক্তি হয়েছে, কিন্তু তা নিয়ে আর নতুন কোনো মতভেদ দেখা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রের পক্ষে সরকারের সার্বভৌমত্বই মেনে নেওয়া হয়েছে সেক্ষেত্রে। তবে হ্যাঁ, নিশ্চয়ই রাষ্ট্রের সব কার্যক্রম জনসাধারণের নজরে আসবে কি আসবে না- তা অন্য আরেক বিতর্ক। অর্থাৎ, রাষ্ট্র তার প্রয়োজনে যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা কি তার জনসাধারণকে জানাতে বাধ্য, এ প্রশ্নে সারা বিশ্বের রাষ্ট্র-বিজ্ঞানীরাই বিভক্ত। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার যে সামরিক চুক্তি সম্পাদন করে, সর্বক্ষেত্রে তা প্রকাশ করাও হয় না। অনুরূপভাবে প্রকাশ করা হয় না রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে অস্ত্র বাণিজ্যের পূর্ণাঙ্গ তথ্য-উপাত্ত। উন্নত বিশ্বে সমরাস্ত্র নীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে নানান আলোচনা সব সময়ই দেখা যায়। কিন্তু এর পাশাপাশি যখন অন্য বিষয়গুলো ঘটে, তখন স্পর্শকাতর বিষয়গুলো খুব একটা সামনে আসে না। তবে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের শপথ থাকে যে, তারা যা কিছু করবেন- তা রাষ্ট্র এবং জনগণের মঙ্গলের জন্যই করবেন। জনগণের ভোটের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে সেই অধিকার রাষ্ট্রের পক্ষে নির্বাচিত সংসদ তথা সরকার পালন করে।
তবে সামরিক বিষয়গুলো জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করার একটি রীতি-নীতি চালু আছে অনেক রাষ্ট্রে। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি এবং বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ জনবসতির দেশ চীন এক্ষেত্রে একেবারেই ভিন্ন অবস্থানে। সে তার জনগণকে কোনো কিছুই জানতে দিতে চায় না। কখন, কিভাবে ও কি হচ্ছে- তা জনগণের জানার অধিকার নেই, এমনি একটি অবস্থা বিরাজমান দেশটিতে। কিন্তু, আমাদের দেশে কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশে যে পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারণা বিদ্যমান, সেখানে রাষ্ট্রের কার্যক্রমকে জনসাধারণের কাছে তুলে ধরাটাই অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। আমাদের দীর্ঘ ৫০ বছরের ইতিহাসে স্বাধীনতা থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত এই বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়নি। আমরা একটি দুর্ঘটনায় নানান আলোচনায় অংশ নেই, তারপর কিছুদিন পর সে আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা জনগণের কাছ থেকে হারিয়ে যায়। আমাদের দেশে আগে 'সুইডেন আসলাম ' বলে খ্যাত একজন অপরাধীকে রাষ্ট্রের নিকট আত্মসমর্পণ এবং ক্ষমা-প্রদর্শন অত্যন্ত সংগোপনে করা হয়েছিল। বিষয়টি জনসাধারণের কাছে কোনোভাবেই তুলে ধরা হয়নি। গণমাধ্যম অনেকদিন পরে বিষয়টি জনগণের কাছে তুলে ধরেছিল।
আমাদের রাষ্ট্রপতি যে কাউকেই ক্ষমা করতে পারেন এবং তার ক্ষমা করার জন্য কোনো কারণ দর্শানোর প্রয়োজন নেই। ক্ষমাপ্রার্থী ব্যক্তি কোন প্রেক্ষিতে ক্ষমা পাচ্ছেন- তা অনেক সময় সাধারণ মানুষ জানতে পারে না। সাম্প্রতিক এক ঝড় তোলা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে বিদেশি একটি গণমাধ্যম। তারা যে সমস্ত বিষয় নিয়ে এসে, আমাদের দেশের নানা দিক তুলে ধরেছে--তার তথ্যভিত্তিক সত্যতার বিষয় একটি আলোচনা বটে! তবে প্রধান যে আলোচনা, এই সংবাদ মাধ্যমটি কি কারণে হঠাৎ করে এমন একটি বিষয়কে সামনে নিয়ে আসলো? গোয়েন্দা যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে- অমুক দেশ থেকে। কোন দেশ, কোন দেশ থেকে গোয়েন্দা যন্ত্রপাতি কিনেছে বা কিনছে, সেটা সেই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, নিজ প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী এধরনের কেনাকাটা করবে- এটাই স্বাভাবিক ব্যাখ্যা। যেভাবে দেখেন না কেন, এই ব্যাখ্যাটাই চূড়ান্ত। গোয়েন্দা সক্ষমতা অন্যতম বিষয়। সেই কারণে পেট্রো-ডলার সমৃদ্ধ, বিশ্বের নির্বাচনবিহীন একটি রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া গণমাধ্যমটি বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক একটি অবস্থান গ্রহণ করেছে বলেই মনে করা যেতে পারে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক