তুলার মূল্যবৃদ্ধি, সংকটে বস্ত্র খাত
বৈশ্বিক উৎপাদনে ঘাটতির আশঙ্কায় বেড়েই চলেছে তুলা ও সুতার দাম। বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে সুতা ও বস্ত্র উৎপাদনকারীরাও এখন উদ্বেগের মুখে। তুলা ও সুতার মূল্যবৃদ্ধি পরোক্ষভাবে পুরো বস্ত্র খাতকেই হুমকির মুখে ফেলেছে।
উল্লেখজনকভাবে উৎপাদনমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদনকারীদের বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
তৈরি পোশাকের প্রচুর অর্ডার থাকলেও বিশ্ব বাজারে মূল্য কম থাকায় রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের দেখা পাচ্ছে না। পাশাপাশি, সুতার মূল্য অত্যধিক হওয়ায় উৎপাদনে হিমশিম খাচ্ছে বহু প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে, অনেকেই প্রতিযোগিতার বাইরে ছিটকে যাচ্ছে।
স্থানীয় বাজারের বস্ত্র ও পোশাক উৎপাদনকারীরা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্নের মুখে থাকলেও, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকায় তারা তেমন একটা লাভ করতে পারছেন না।
এদিকে, তুলার মূল্যবৃদ্ধিতে উদ্বেগের মুখে আছেন ক্ষুদ্র সুতা উৎপাদনকারীরা। সুতা উৎপাদনের মূল কাঁচামাল তুলা এখন তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশি একটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান গত বছর ভারত থেকে প্রতি কেজি ৩০ কাউন্ট সুতা ৩ ডলার মূল্যে কিনলেও এ বছর গুনেছে ৪.১ ডলার।
বড় সুতা উৎপাদনকারীরা সাধারণত ফিউচারস বা ভবিষ্যৎ বাজার (ভবিষ্যতে নির্ধারিত মূল্যে পণ্য সরবরাহের চুক্তি) থেকে তুলা কিনতে সিঙ্গাপুরে অফিস পরিচালনা করে থাকে। দরকষাকষির মাধ্যমে আগে-ভাগে তুলা কিনে নেওয়ার বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোকে অস্থিতিশীল ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা মূলত দেশীয় পোশাকের চাহিদা পূরণ করে থাকে, তাদের রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে হচ্ছে।
দেশের বাইরে অফিস না থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে চড়া দামে তুলা কিনতে হয়।
বাংলাদেশে আংশিকভাবে হেজিং বা দর পরিবর্তনের আশঙ্কায় আগে-ভাগে চুক্তির সুবিধা থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনুমতি নিতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। ফলে, রাতারাতি পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে কোনো লাভই হয় না।
কটন মার্কেট ফান্ডামেন্টাল অ্যান্ড প্রাইজ আউটলুকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ বছরের মে মাসে দ্য নিউইয়র্ক নিয়ারবাই এবং দ্য ডেইলি অ্যা ইনডেক্স অনুসারে তুলার মূল্য প্রতি পাউন্ড যথাক্রমে দশমিক ৫৬ ডলার এবং দশমিক ৬ ডলার করে থাকলেও এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা বৃদ্ধি পেয়ে দশমিক ৮৮ ও দশমিক ৯২ ডলারে পৌঁছেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) তথ্যানুসারে, ২০১৯-২০ ফসলি বছরে বৈশ্বিক তুলার উৎপাদন ছিল ২৬.৫৯ মিলিয়ন টন। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০-২১ বছরে উৎপাদন কমে ২৪.৮৫ মিলিয়ন টনে নেমে আসবে। বলে রাখা ভালো, তুলার ফসলি বছর ১ আগস্ট থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ধরা হয়।
শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্রানুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বাজার দর অনুসারে বৈশ্বিক তুলার মূল্য নির্ধারিত হয়।
বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ চীন একইসঙ্গে বিশ্বের বৃহত্তম তুলা উৎপাদন ও ব্যবহারকারী দেশ। আটককৃত উইঘুর মুসলিমদের দিয়ে জোর করে তুলা উৎপাদনের অভিযোগে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের জিনজিয়ান প্রদেশ থেকে উৎপাদিত তুলার তৈরি সকল সুতি পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ করে। ফলে, চীনকে এখন বাধ্য হয়েই অন্য দেশ থেকে অতিরিক্ত তুলা আমদানি করতে হচ্ছে।
জিনজিয়ানে উৎপাদিত তুলা থেকে প্রস্তুত কাঁচা তন্তু থেকে শুরু করে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক নিষিদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
স্ট্যাটিস্টা ডট কম এবং ইউএসডিএর সূত্রানুসারে, ২০১৯ সালে চীনে মোট উৎপাদিত ৬.৩ মিলিয়ন টন সুতার প্রায় ৫ মিলিয়ন টনই ছিল জিনজিয়ানে উৎপাদিত।
সাম্প্রতিক সময়ে মাসব্যাপী সীমান্ত উত্তেজনা কমার পর চীন এখন ভারত থেকে বিশাল আয়তনে তুলা ও সুতা আমদানি করছে।
শিল্প-সংশ্লিষ্ট একজন জানান, চীন ইতোমধ্যেই ভবিষ্যৎ বাজারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ তুলা কিনে ফেলেছে। ফলে, বিশ্ব বাজারে তুলার সরবরাহ ব্যাহত হবে।
ঊর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, 'গত দুই মাসের তুলনায় বর্তমানে আমরা অতিরিক্ত ১ ডলার দিয়ে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার কাছ থেকে ৩০/১ কাউন্টের সুতা কিনছি।'
'আমার প্রতিষ্ঠানের এখন না কোনো ক্ষতি হচ্ছে, না হচ্ছে লাভ,' বলেন তিনি।
'ক্রেতারা এখন বাড়তি দাম দিতে চাচ্ছেন না। আমরা তাদের বোঝাতেও ব্যর্থ হয়েছি,' বলেন আসিফ।
ফতুল্লা অ্যাপারেল লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে শামীম ইহসান বলেন, 'তুলার মূল্যবৃদ্ধির সুবিধা নিয়ে সুতা উৎপাদনকারীরা অতিরিক্ত মূল্য আদায় করছে।'
তিনি বলেন, 'সুতা উৎপাদনকারীরা প্রতি কেজি তুলার জন্য ১ থেকে ১.৩ ডলার পর্যন্ত বাড়তি অর্থ রাখছে। অথচ প্রতি কেজি তুলার মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ দশমিক ২০ ডলার থেকে দশমিক ২৫ ডলার পর্যন্ত। ফলে আমরা কোনো লাভ করতে পারছি না।'
একজন ক্রেতা তুলার মূল্যবৃদ্ধির জন্য তার ২৫ হাজার পিস নিট আইটেমের অর্ডার বাতিল করতে চেয়েছিলেন বলে জানান তিনি।
নরসিংদীভিত্তিক বিসমিল্লাহ টেক্সটাইলের মালিক মোহাম্মদ হাসান বলেন, 'নারীদের পোশাক তৈরির জন্য আমরা গত বছরের ডিসেম্বরে স্থানীয় বাজার থেকে ৮০ কাউন্টের সুতা পাউন্ড প্রতি ২৩০ থেকে ২৫০ টাকা দরে কিনেছি। কিন্তু বর্তমানে প্রতি পাউন্ড সুতার মূল্য ৩৫ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।'
ফলে প্রতি গজ কাপড়ের মূল্য ৫ টাকা করে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজার দরের সঙ্গে এই বাড়তি খরচের সামঞ্জস্যতা আনা বেশ কঠিন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মোহাম্মদ হাসান আরও জানান, তার প্রতিষ্ঠান উৎপাদন অর্ধেক কমিয়ে এখন প্রতি মাসে পাঁচ লাখ গজ সুতি কাপড় প্রস্তুত করছে।
এছাড়া, তুলার মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে সুতার ডিলার ও উৎপাদনকারীরা অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, 'বিশ্ব বাজারে তুলার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সুতার মূল্য বেড়ে গেছে।'
এ বছর তুলার উৎপাদন কমার আশঙ্কায় তুলার মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই বছর ধীরগতিতে আগালেও, চীন এখন আগে-ভাগেই সুতা কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে।
এছাড়া, করোনাকালে বিশ্ববাজারে আগের বছরের তুলনায় সুতির তৈরি নিটওয়্যারের চাহিদা ৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'অতিরিক্ত চাহিদা থাকায় বস্ত্র উৎপাদনকারীরা অরগানিক বা প্রাকৃতিক তুলার সংকটে আছেন।'
একইসঙ্গে, ভারতীয় কিছু প্রাকৃতিক তুলা সরবরাহকারী প্রতারণার কারণে তাদের অনুমোদন হারিয়েছেন। ফলে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
'তিন মাস আগে অরগানিক তুলার মূল্য পাউন্ডপ্রতি দশমিক ৮৪ ডলার থাকলেও, এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে ১.১৬ ডলার হয়েছে,' বলেন তিনি।
বস্ত্র উৎপানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ৬০০ টন অরগানিক কটনের অর্ডার দিলেও সময়মতো তা আসেনি বলে জানান কুতুব উদ্দিন।
বিশ্বের প্রথম সবুজ ডেনিম টেক্সটাইল কারখানার চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দিন আরও বলেন, 'আমরা ভারত থেকে কিছু অরগানিক তুলা পেয়েছি। কিন্তু তাদের অনেকেই শিপমেন্টের পর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সার্টিফিকেট পাঠায়নি।'
বিটিএমএর সূত্রানুসারে, বাংলাদেশের স্পিনিং ও টেক্সটাইল কারখানাগুলোর বার্ষিক ২৭ লাখ টন তুলা ব্যবহারের সক্ষমতা রয়েছে।
গত বছর তুলার ব্যবহার ছিল প্রায় ১৫ লাখ ৮৯ হাজার টন। অন্যদিকে, ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৪২ হাজার টন।
পণ্য জাহাজীকরণে কৃত্রিম সংকট
বাংলাদেশি আমদানিকারকরা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কলম্বো সমুদ্র বন্দর থেকে তুলা আমদানি করে থাকে। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের কাছে প্রতিটি চালান আসতে তিন মাসের বেশি সময় লাগত; বর্তমানে তা ছয় থেকে সাত মাসও পেরিয়ে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাংলাদেশি ইন্ডেন্টিং এজেন্ট বলেন, 'আমাদের তুলার চালান ৬০ দিন ধরে মালয়েশিয়ার বন্দরে আটকে আছে। সাধারণত ৪৫ দিনের মধ্যেই পশ্চিম আফ্রিকা থেকে চালানগুলো চলে আসে।'
'মালগুলো কবে এসে পৌঁছাবে সে সম্পর্কে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই,' বলেন তিনি।
ফ্রেইট ফরওয়ার্ডাররা অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের জন্য কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। চীনে পণ্য আটকে থাকা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এসব করা হচ্ছে বলে তিনি ব্যখ্যা করেন। এর ফলে পণ্য পরিবহণের খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি ভারতীয় কনটেইনার পরিবহনের উদাহরণ দেন। করোনার আগে তা দুই হাজার ডলার থাকলেও, করোনা পরবর্তী সময়ে এর খরচ সাড়ে চার হাজার ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে।
তুলা সরবরাহকারীরা মাল বাহনের খরচ বহন করলেও, খরচ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন পিছু হটছেন।
বিটিএমএর সাবেক সহ-সভাপতি মোহাম্মদ ফজলুল হক বলেন, 'পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের বিশ্ব বাজারে অবস্থান হারাবে।'
মৌলিক কাঁচামাল না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র ও বৃহত্তম একক আইটেম রপ্তানিকারক দেশ বলে উল্লেখ করেন দুটি টেক্সটাইল ও দুটি স্পিনিং মিলের মালিক ফজলুল হক।