মার্কিন সমাজের বর্তমান বিভাজন ও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোন পথে হাঁটছে? দেশটি যে চূড়ান্তভাবে বিভাজনের পথেই চলছে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ধারণা করা হয়েছিল, জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার ভেতর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিভাজনের রাস্তা থেকে ফিরে আসবে, কিন্তু তা ঘটেনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিভিন্ন উগ্রবাদী পদক্ষেপে তার দল রিপাবলিকান পার্টির যেরকম ভরাডুবি হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তাও কিন্তু ঘটেনি। রিপাবলিকান দলের নির্বাচনী ফলাফল অন্তত তাই বলে।
রিপাবলিকান দল হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ (কংগ্রেস) জয়লাভ করতে পারেনি, কিন্তু কয়েকটি আসন ঠিকই ছিনিয়ে নিয়েছে। ২০২০ এর নির্বাচনে রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য সদস্য সংখ্যা ১৯৯ থেকে ২১১তে বৃদ্ধি পেয়েছে। রিপাবলিকান দলের সিনেট নির্বাচন, সেখানেও যতোটা আশঙ্কা করা হয়েছিল ততোটা খারাপ করেনি দলটি।
রিপাবলিকান পাঁচ জন সিনেট সদস্য ট্রাম্পের অভিসংশনের পক্ষে ভোট দিলেও, এখন মনে হচ্ছে বাইডেনের পদক্ষেপগুলো রিপাবলিকান দলকে পুনর্গঠিত হতে সহায়তা করছে। জো বাইডেন তার বেশকিছু পদক্ষেপ ভোটার সংগ্রহ করার জন্য নিয়েছে বলেই মনে করা হয়। আমেরিকায় প্রায় এক কোটির উপরে বেআইনিভাবে বসবাসরত মেক্সিকান মানুষ রয়েছেন। এর বাইরে অন্যান্য দেশের অবৈধ অভিবাসীও কিছু আছে; যদিও তাদের তুলনায় প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকো থেকে আসাদের সংখ্যাই অনেক বেশি। বাইডেন তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৈধতা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, বাইডেন আগামী নির্বাচনের জন্য ভোটার সংগ্রহ করার জন্যই এটা করেছেন। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাভাবিক চাহিদায় এই জনসংখ্যা অর্থনীতির জন্য কতটা সুখকর হবে- তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।
বাইডেন ট্রাম্পের অনুসৃত মধ্যপ্রাচ্য নীতি বহাল রেখেছেন। গত দুইদিন আগে মার্কিন বাহিনী আবারো সিরিয়াতে বিমান হামলা চালিয়েছে, যাতে মারা গেছে ১৭ জন। বাইডেন চীনের বিরুদ্ধে তার অবস্থান ট্রাম্পের মতনই রেখেছেন। ইরানের সাথেও মার্কিন অবস্থানের কোনো পরিবর্তন করেননি। চীনের বিরুদ্ধে সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করছে তার উত্তর আমেরিকা মহাদেশীয় প্রতিবেশী দেশ কানাডাকে। কানাডার পার্লামেন্টে ইতোমধ্যেই উইঘুর সম্প্রদায়ের গণহত্যা সংক্রান্ত একটি অভিযোগ সামনে নিয়ে এসে চীনের বিরুদ্ধে তাদের পার্লামেন্টে একটি আইন পাস করার চেষ্টা করছে।
অথচ উত্তর আমেরিকার এই দেশ, কানাডা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে বেআইনি পন্থায় প্রেরিত অর্থের বিনিময়ে নাগরিকত্ব দিচ্ছে। কানাডার মতো শুধু টাকার বিনিময়ে নাগরিকত্ব প্রদান করার বিধান পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। তবে টাকার বিনিময়ে আরো কয়েকটি দেশেও ঠিকানা গড়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে কানাডায় বসবাস এবং নাগরিকত্বের সুযোগ নেওয়া যাচ্ছে, এখবর আমাদের দেশের গণমাধ্যমেরই ফলাও করে দেওয়া। পত্রিকার বরাতেই আমরা জানি, বহু আর্থিক কেলেঙ্কারির সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের বর্তমান ঠিকানা কানাডার বেগম পাড়া। কানাডীয় পার্লামেন্টের উচিত নাগরিকত্ব সুবিধা সম্পর্কিত এই অভিবাসন নীতি পরিবর্তন করা।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে অনৈতিক অনিয়মের ভিতর দিয়ে যে অর্থ পাচার করা হয়, সেই অর্থের বিনিময়ে কানাডা তাদের নিরাপত্তা প্রদান করছে। অন্য দু-একটি দেশের বেলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই।
সাধারণভাবে, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে টাকা পাঠানোর জন্য সেই দেশে একটি ইনকোয়ারির মুখোমুখি হতে হয়। যেমন, যুক্তরাজ্যে বিনিয়োগের মাধ্যমে বসবাসের সুযোগ বা নাগরিকত্ব দুই অর্জন করা সম্ভব। তবে শর্ত হচ্ছে, যুক্তরাজ্যে বিনিয়োগ করতে হলে নিজ দেশ থেকে বৈধ পথে টাকা পাঠাতে করতে হবে। অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সুযোগ এক ধরনের বিধি-নিষেধের আওতায় আনা হয়েছে, ২০০১ সালের টুইন টাওয়ার সন্ত্রাসী হামলার পর থেকেই। এই দেশগুলোয় বৈদেশিক অর্থ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এক ধরনের নজরদারির ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। কিন্তু দুবাই, কানাডা ইত্যাদি জায়গায় টাকা পাঠানোর জন্য কোনো ইনকোয়ারির প্রয়োজন হয় না। আমাদের দেশের মতন অন্য ভুক্তভোগী দেশগুলোর যৌথভাবে জাতিসংঘে বিষয়টি উত্থাপন করা উচিৎ, তাহলে জাতিসংঘ বিষয়টিতে আন্তর্জাতিকভাবে একটি অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে।
রিপাবলিকান দলের প্রধান গতকাল ঘোষণা করেছেন, ট্রাম্প যদি ২০২৪ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রতিনিধি হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মনোনয়ন পান- তবে তিনি এবং রিপাবলিকান দল তাকে সমর্থন করবেন। যদিও মাত্র কয়েকদিন আগে সিনেটে শুনানিকালে তিনি ট্রাম্পের 'সাধারণ ফৌজদারি আদালতে বিচার হওয়া উচিত' বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনায় ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেছিলেন। অথচ, সিনেটে ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। যেকারণে ট্রাম্পের অভিসংশন উদ্যোগ সিনেট কর্তৃক গৃহীত হয়নি।
নির্বাচনের পূর্বে মার্কিন নাগরিকরা বিভিন্ন ধরনের বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের ভূমিকাকে সমালোচনা করে বাইডেনের পক্ষ নিয়েছিলেন। মার্কিনীরা দেশের অভ্যন্তরীণ অন্যায়ের প্রশ্নে যতটা সোচ্চার; বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে ততোটাই নীরব। মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ এবং যুদ্ধাবস্থা বজায় রাখা, যুদ্ধে নারী-শিশুসহ বেসামরিক মানুষের মৃত্যু, মানবতা ও মানবাধিকার লংঘন প্রশ্নে ট্রাম্প এবং জো বাইডেনের সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে কোনো বিভাজন দেখা যায় না। ফলে যিনি ক্ষমতায় আসবেন তিনিই মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ লুন্ঠনসহ পৃথিবীর সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন, এটাই স্বাভাবিক।
ডেমোক্রেট আর রিপাবলিকান দল- উভয়ই রাজনীতিতে প্রাধান্য দেয় জাতীয় স্বার্থ। মার্কিন গোয়েন্দা রির্পোটে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে সৌদি প্রিন্স সালমানের সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও; মার্কিন প্রশাসন সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিশ্বের নানা প্রান্তে যে সমস্ত মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে বা ট্রাম্প সময়কালের ঘটনা যেমন ভারতের কাশ্মীরে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল, কাশ্মীরী জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ, ইন্টারনেটসহ সবরকম যোগাযোগ সংযোগ বিছিন্ন করাসহ নিজ দেশে পরবাসী করে রাখার ভারতীয় নীতির বিরুদ্ধে এবং সাম্প্রতিক মিয়ানমার প্রশ্নে বাইডেন প্রশাসনকে খুব বেশি উদ্যোগী বা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাবে না।