‘কঙ্কাল হ্রদে’র রহস্য
ভূত-প্রেতে বিশ্বাস থাকলে হিমালয়ের রূপকুণ্ড হ্রদে ভ্রমণের চিন্তা এখনই পরিহার করুন! হিমালয় চূড়ায় পাহাড়ি উপত্যকার তীরবর্তী রূপকুণ্ড ঘিরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শত শত নর কঙ্কাল।
ভারতের অন্যতম বৃহৎ পর্বতশৃঙ্গ ত্রিশুলের পাদদেশে রূপকুণ্ডের অবস্থান। উত্তরখণ্ড প্রদেশে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ হাজার ২৯ মিটার উচ্চতায় হ্রদটি অবস্থিত।
'কঙ্কাল হ্রদ' নামে পরিচিত হ্রদটির আশেপাশে বরফে ঢাকা অবস্থায় দেখা মিলবে এসব কঙ্কালের। ১৯৪২ সালে এক ব্রিটিশ ফরেস্ট রেঞ্জার কঙ্কালগুলোর সন্ধান পান।
বছরের অধিকাংশ সময় বরফে আচ্ছন্ন থাকে এই লেক। আবহাওয়া ও ঋতু পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হয় এর আকৃতি। তবে, কেবলমাত্র বরফগুলো গলে যাবার পরেই কঙ্কালের দেখা পাওয়া যায়। কখনো কখনো কঙ্কালের গায়ে জড়ানো মাংসপেশির দেখাও মিলতে পারে। বরফের কারণে সেগুলো আজও অক্ষুণ্ণ আছে।
এই অবধি, এখানে প্রায় ৬০০-৮০০ মানুষের কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া গেছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে স্থানীয় সরকার লেকটিকে 'রহস্যময় হ্রদ' হিসেবে বর্ণনা করে থাকে।
প্রায় অর্ধ শতাব্দীরও অধিক সময় ধরে নৃতাত্ত্বিক এবং বিজ্ঞানীরা মানবদেহের এই অবশিষ্টাংশ নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। কিন্তু, প্রতিবারই হাজারো প্রশ্নের গোলকধাঁধাঁয় ফেঁসে চলেছেন তারা।
এই মানুষদের পরিচয় কী? কবে এবং কীভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছিল? তারা এসেছিলই বা কোথা থেকে?
পুরোনো এক তত্ত্ব অনুযায়ী কঙ্কালগুলো ভারতীয় এক রাজা, তার স্ত্রী এবং রাজ কর্মচারীদের। আজ থেকে প্রায় ৮৭০ বছর আগে কোনো এক সময়ে তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে তারা মারা যান।
অন্য একটি সূত্র অনুযায়ী, কঙ্কালগুলোর কয়েকটি ভারতীয় সৈন্যের। ১৮৪১ সালে তিব্বত আক্রমণের পর তারা পরাজিত হয়। ৭০ জনের অধিক সৈন্যকে জোর করে ফেরত পাঠানো হয়। ফেরার পথে হিমালয়েই মারা পড়েন তারা।
অপর এক সূত্রানুসারে, এখানে একসময় গোরস্তান ছিল। মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে এখানে পুঁতে ফেলা হত।
স্থানীয় গ্রামগুলোতে হ্রদকে ঘিরে এক জনপ্রিয় লোক সংগীত আছে। গানটির কথা অনুযায়ী, দেবী নন্দা "লোহার মতো শক্ত" এক শিলাবৃষ্টির ঝড় তৈরি করেছিলেন। সেই ঝড়ে হ্রদটির আশেপাশের মানুষ মারা পরে। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম শৃঙ্গ নন্দা। ভক্তরা তাকে নন্দা দেবী হিসেবেই মানেন।
পূর্ববর্তী গবেষণা অনুযায়ী, এখানে মৃত ব্যক্তিদের অধিকাংশই গড়পরতার চেয়ে উচ্চতায় লম্বা ছিলেন। অধিকাংশই ছিলেন ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। কোনো, শিশুর কঙ্কাল এখানে নেই। তবে, বয়স্ক নারীদের কঙ্কাল পাওয়া যায়। প্রত্যেকেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন।
ধারণা করা হত সবগুলো কঙ্কালই একটি নির্দিষ্ট দলের। নবম শতাব্দীতে কোনো এক দুর্যোগের কবলে পড়ে যাত্রীরা নিহত হন।
তবে, সাম্প্রতিক কালে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানির ১৬ টি প্রতিষ্ঠানের ২৮ জন সহ-লেখকের মিলিত উদ্যোগে পাঁচ বছর মেয়াদী দীর্ঘ এক গবেষণার ফলাফল এতদিনকার ধারণাগুলোকে উড়িয়ে দিচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা জিনগত বিশ্লেষণ এবং কার্বন-ডেটিং এর মাধ্যমে ১৫ জন নারীসহ ৩৮ টি দেহের উপর পরীক্ষা চালায়। এর মধ্যে কয়েকটি দেহ ১২০০ বছরের পুরনো বলে জানা যায়।
গবেষকরা জানান, মৃতদের মধ্যে জিনগত বৈচিত্র্য বিদ্যমান। এছাড়া, তাদের মৃত্যুর সময়কালও ভিন্ন। হাজার বছরের ব্যপ্তি জুড়ে রয়েছে এই মৃত্যুকাল।
গবেষণাটির প্রধান লেখক ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টোরাল ছাত্র ইয়াডাওয়িন হারনে বলেন, "একক কোনো দুর্যোগের সমস্ত ব্যখ্যাকেই উল্টে দিচ্ছে এই গবেষণা। রূপকুণ্ড লেকে কী হয়েছিল তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে এখন আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, এখানকার মৃত্যুর জন্য কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা দায়ী নয়।"
তবে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় হল যে, জেনেটিকাল পাঠের মাধ্যমে বিচিত্র সব মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে। একটি দলের সাথে বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসীদের জিনগত মিল রয়েছে। অন্যদিকে, অপর এক দলের সাথে মিল আছে বর্তমান ইউরোপ নিবাসীদের। বিশেষত, গ্রীসের ক্রিট দ্বীপের বাসিন্দাদের সাথে তাদের সাদৃশ্য আছে।
একই সাথে, দক্ষিণ এশিয়ার মানুষেরাও একই জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নন।
"কিছু দলের সাথে উপমহাদেশের উত্তর অংশের পূর্বপুরুষদের মিল থাকলেও, বাকিদের সাথে মিল পাওয়া যাবে দক্ষিণীদের," বলেন হারনে।
তবে কি বিচিত্র এই মানুষেরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ হয়ে শত শত বছর ধরে এই পথে যাত্রা করে চলছিলেন?
জায়গাটিতে অবশ্য কোনো যুদ্ধাস্ত্র বা মালামালের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এমকি হ্রদটি কোনো বাণিজ্য পথেও পড়ে না। জেনেটিক গবেষণায় কোন ব্যাক্টেরিয়াল প্যাথোজেনের সন্ধান পাওয়া যায়নি যার মাধ্যমে কোনো রোগ বা মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করা যাবে।
তবে, তীর্থযাত্রাই একমাত্র এই অঞ্চলে ভ্রমণ সম্পর্কিত প্রশ্নের সমাধান হতে পারে। ১৯ শতকের শেষ ভাগের আগে এই অঞ্চলে তীর্থযাত্রীদের তেমন আনাগোনার কথা গবেষণায় পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় মন্দিরগুলোর অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীর পুঁথিগুলো স্থানটির বেশ প্রাচীন উৎপত্তির ইঙ্গিত দিবে।
বিজ্ঞানীরা তাই বিশ্বাস করছেন যে, তীর্থযাত্রার সময় বড় কোনো দুর্ঘটনায় বিশাল সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
কিন্তু প্রশ্ন হল ভূমধ্য পূর্ব অঞ্চলের মানুষ ভারতের পর্বত চূড়ায় কী করছিল?
ইউরোপের ঐ যাত্রীরা সম্ভবত রূপকুণ্ডের সনাতন তীর্থস্থানে এসে থাকতে পারেন বলে জানান এই গবেষক।
তবে এমনও হতে পারে যে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের পূর্বপুরুষদের একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে কয়েক প্রজন্ম ধরেই এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছিল।
"আমরা এখনও উত্তর খুঁজে চলেছি," বলেন হারনে।
- সূত্র: ইয়াহু নিউজ