ভ্যাকসিন সরবরাহে শীর্ষে অথচ খোদ রাশিয়ানদের ভ্যাকসিন গ্রহণে অনাগ্রহ
কয়েক দশক আগেও সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা ভলগিনস্কি অঞ্চলকে নিজেদের জীবাণু অস্ত্র গবেষণার কাজে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু মস্কো থেকে ৭০ মাইল পূর্বে অবস্থিত এই এলাকা এখন ব্যবহৃত হবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে। বিশাল বড় পরিসরে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে।
বিশ্ববাসীকে মহামারির ছোবল থেকে সুরক্ষা যোগাতেই রাশিয়ার এই উদ্যোগ।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে রাশিয়ার 'স্পুটনিক ফাইভ' নামক ভ্যাকসিন তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জেনেরিয়াম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিকে। সিএনএন সূত্রে জানা যাচ্ছে ভলগিনস্কি অঞ্চলে জেনেরিয়াম ফার্মাসিউটিক্যাল বিশাল ফ্যাক্টরি গড়ে তুলেছে, রুশ সরকার এ কোম্পানিকে একটি আধুনিক যুগোপযোগী কারখানা হিসেবে গড়ে তোলার অত্যাধুনিক সব
সুযোগ সুবিধার যোগান দিয়েছে। যে কারণে রাশিয়াজুড়ে সাতটি ভ্যাকসিন উৎপাদন কেন্দ্রের মধ্যে জেনেরিয়াম ফার্মাসিউটিক্যাল একটি হাই-টেক কমপ্লেক্স।
ভ্যাকসিন উৎপাদনের নকশা ও পানি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়াসহ প্রতিটি ধাপেই বাড়তি সতর্কতার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এ কমপ্লেক্সে। জেনেরিয়ামের চীফ সায়েন্স অফিসার দিমিত্রি পটারিয়ায়েভ সিএনএনকে বলেন, "গোড়ায় আমরা শুধু ল্যাবে ছোট পরিসরে ভ্যাকসিন বানিয়ে দেখেছি, কিন্তু বড় পরিসরে বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে ভ্যাকসিন বানানো পর্বতসম কাজ। এখানে সব কিছু আলাদা, প্রতিটি ধাপের অক্সিজেনেশন এবং মাস ব্যালেন্স সব আলাদা।"
পটারিয়ায়েভ জানাতে ভোলেন না যে, এসব ধাপ তারা আসলে ছয়-সাত মাস আগেই পার করে এসেছেন এবং এখন তাদের ফ্যাক্টরি পুরোপুরি উৎপাদনের কাজে জড়িত। তারা এখন প্রতি মাসেই মিলিয়ন মিলিয়ন ডোজ টিকা বানাচ্ছেন এবং আশা করছেন ভবিষ্যতে প্রতি মাসে তারা ১০ থেকে ২০ মিলিয়ন ডোজ উৎপাদন করতে পারবেন।
রাশিয়ার হাড় কাঁপানো শীতের চাইতেও শীতল ওয়াক-ইন রেফ্রিজারেটরে হাজার হাজার স্পুটনিক ফাইভ ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা হয়েছে। এগুলো অপেক্ষায় আছে বিতরণের। প্রতিটি ভ্যাকসিন বোতলে আলাদা কিউআর কোড দেওয়া আছে, ফলে পৃথিবীর যে প্রান্তেই এই ভ্যাকসিন নেওয়া হোক কেন তা হিসেবের মধ্যেই থাকবে, চিহ্নিত করা যাবে।
রাশিয়ার এই স্পুটনিক ফাইভ ভ্যাকসিন এখনো পর্যন্ত সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রি-অর্ডারকৃত ভ্যাকসিন। এতো বিপুল সংখ্যায় টিকার সরবরাহের অর্ডার স্পুটনিকের দখলেই। রাশিয়ান ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড সূত্রে জানা যায়, আর্জেন্টিনা থেকে ফিলিপাইনের মত দেশগুলোর সঙ্গে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডোজ সরবরাহের চুক্তি সই হয়েছে রাশিয়ার।
ভ্যাকসিনে অনাগ্রহ রুশদের
বহির্বিশ্বে রাশিয়ার মধ্যেই স্পুটনিক ফাইভ ভ্যাকসিনের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও খোদ রুশদের মধ্যে এই টিকা গ্রহণে অনাগ্রহ দৃশ্যমান।
৪ দশমিক ১ মিলিয়ন কোভিড রোগীর কেস নিয়ে রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম করোনা আক্রান্ত দেশের একটি। রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান থাকা সত্ত্বেও রাশিয়ার জনসাধারণের মধ্যে ভ্যাকসিন নেয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি কুন্ঠা বা দ্বিধার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেভাডা সেন্টার আয়োজিত এক জরিপে দেখা যায় মাত্র ৩৮% রুশ ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী।
এ মাসের শুরুতে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মূল বিজ্ঞানীদের একজন জানিয়েছিলেন যে রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার মাত্র ২% লোক ভ্যাকসিনের প্রাথমিক ডোজ নিয়েছে।
স্পুটনিক ফাইভই বিশ্বে সর্বপ্রথম অনুমোদিত করোনা ভ্যাকসিন। 'স্পুটনিক ফাইভ' নাম নিয়েও কম আলোচনা-সমালোচনা হয়নি! ১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মহাকাশ অভিযানে পাল্লা দেয়ার জন্যে যে প্রথম স্যাটেলাইট পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন, তার নামানুসারে এই ভ্যাকসিনের নামকরণ করা হয় স্পুটনিক ফাইভ। সমালোচকরা এখন বলছেন, 'পুতিনের ভ্যাকসিন' আবারও দৌড়ে প্রথম হওয়ার জন্যই মাঠে নেমেছে।
স্পুটনিক ফাইভের কার্যকারিতাও চমৎকৃত হওয়ার মতোই। হিউম্যান ট্রায়াল সম্পন্নের পর গত মাসে প্রকাশিত ল্যানসেট মেডিক্যাল জার্নালের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এই ভ্যাকসিনটি ৯১.৬ শতাংশ কার্যকর।
তবুও রুশ এই ভ্যাকসিন নিয়ে, বিরোধিতা করে নানা প্রচারণা ও গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে ইন্টারনেটে। আলেক্সান্ডার আরখিপোভা নামের একজন সামাজিক নৃবিজ্ঞানী বলেন, রুশদের মধ্যে প্রথাগতভাবেই চিকিৎসাবিজ্ঞানকে অবিশ্বাস করার একটা সংস্কৃতি রয়ে গেছে। সন্দেহের পেছনে আরো একটি কারণ হতে পারে যে প্রেসিডেন্ট পুতিনের মেয়ে ভ্যাকসিন নিলেও পুতিন নিজে এখনো নেননি।
ফ্রি আইসক্রিম!
কোনরকম শারীরিক সমস্যা না থাকলে রাশিয়ার সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকই টিকা নিতে পারবেন। কিন্তু রাশিয়ায় টিকার প্রতি মানুষের অনাগ্রহ নিয়ে চিন্তিত রুশ সরকার। তাই সাধারণ মানুষকে ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী করে তোলার জন্যে রুশ সরকার কিছু অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে।
এখন থেকে রাশিয়ার প্রতিটি টিকা কেন্দ্রেই প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন নেয়ার পরই একটি করে বিনামূল্যে আইসক্রিম খেতে পাবে মানুষ।
শুধু তাই নয়, মস্কোতে ফুড হলের ভেতরেও ক্লিনিক খোলা হয়েছে। এখানে যারা সুশি কিংবা স্ট্রিট ফুড খেতে আসছেন, খাওয়া শেষে সবাইকে টিকা নিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
সঙ্গীতপ্রেমীদের জন্যে মস্কো অপেরা হাউজ হেলিকনের ভেতরেও রয়েছে একটি ক্লিনিক, যেন মানুষ গান শুনতে শুনতেই টিকা নিতে পারে।
সরকারের এসব উদ্যোগের পর রাশিয়ার মানুষ কতখানি উৎসাহিত হয়ে কতটা সাড়া দেয় তাই এখন দেখার বিষয়।
- সূত্রঃ সিএনএন