পশ্চিম বাংলার বিধানসভার নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক মেরুকরণ: ধর্মতত্ত্বের আবর্ত
পশ্চিম বাংলার বিধানসভার নির্বাচন মার্চ মাসের ২৭ তারিখ থেকে শুরু হয়ে গোটা এপ্রিল মাস জুড়ে কয়েক ভাগে সম্পন্ন হবে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নির্বাচন কমিশন সেভাবেই প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। মে মাসের ২ তারিখে জানা যাবে রাজ্যের শাসনভার কার কাছে যাচ্ছে।
পশ্চিম বাংলার ২৭ শতাংশ মুসলিম ভোটার নির্বাচনে ফলাফল নির্ধারনে বরাবরই নিয়ামক শক্তি। এই ধারা সাতচল্লিশের ভারত বিভক্তির পর থেকেই। ভারতের মুসলিম ধর্মালম্বীরা সবসময় কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের আবরণে নিজেদেরকে সমবেত করেছে। কংগ্রেসের পতন ঘটেছিল বিরানব্বই সালের বাবরি মসজিদ ধবংসের ঘটনায়। এরপরের ঘটনা ২০০২ সালে গুজরাটের গণহত্যা।
রাজ্যটির মুসলমানদের আহত আবেগকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তৃণমূলের গত ১০ বছর ক্ষমতার পরিণতিতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটেছে- তা জানা যায় না। জনসংখ্যার ভিত্তিতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর যতটুকু অর্জন করার কথা ছিল তার কোনো অংশই অর্জিত হয়নি। সাচার কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, মুসলমানদের জীবনমানের কোন উন্নয়ন ঘটেনি বামফ্রন্টের জমানাতেও। মুসলিম জনগোষ্ঠীর শতাংশ হারে রাজ্যের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মাত্র ২%। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ৯ শতাংশ মুসলিম- এমনি সব তথ্য উঠে এসেছে ঐ রিপোর্টে। এর ফলে বোঝা যায়, মুসলিম জনগোষ্ঠী যে দলকেই আঁকড়ে ধরুক না কেন- ভারতে তাদের প্রকৃত উন্নয়ন ঘটেনি।
পশ্চিম বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি অংশ গ্রামীণ কৃষক, গ্রামে বসবাস করে। শহরের মুসলমানরা উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ বংশীয়। এরাই রাজনীতির প্রধান অংশের নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের ক্ষমতায়নের প্রয়োজনে তারা দল এবং মত পরিবর্তন করে। পশ্চিম বাংলার এবারের নির্বাচনে দেখা গেল, হুগলি জেলার ফুরফুরা শরীফের তত্বাবধানকারী পরিবারের সদস্য আব্বাস সিদ্দিকী ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। আব্বাস সিদ্দিকী কংগ্রেসের কাছে আসন ভাগাভাগির একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। কংগ্রেস আইএসএফ নামক এই রাজনৈতিক দল পশ্চিমবাংলায় তেমন কোনো সাফল্য বয়ে আনবে না তারপরেও এই মুহূর্তে জোট গঠনের কারণ একটাই, নির্বাচনে জয়লাভ।
পশ্চিম বাংলার নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। গত ডিসেম্বর থেকেই পশ্চিমবাংলা বিজেপি'র নেতৃত্বের পদচারণায় মুখর। প্রচুর পরিচিত মুখ তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করছে। এদের মধ্যে অন্যতম শুভেন্দু অধিকারী। একসময় তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জির দক্ষিণ হস্ত। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। পারিবারিকভাবে যারা তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তারা সবাই তৃণমূল কংগ্রেস ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জি ও শুভেন্দু অধিকারী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হবেন বলে মনে করা হচ্ছে। ঘোষণা দেখে তাই মনে হয়।
পশ্চিমবাংলায় এক নতুন অধ্যায়, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার জায়গা থেকে বিজেপির শ্লোগান, 'জয় শ্রীরাম'। এই স্লোগানকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবাংলা উত্তপ্ত। 'জয় শ্রীরাম' এর বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মমতা ব্যানার্জি এক নতুন স্লোগান দাঁড় করালেন, বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান 'জয় বাংলা'। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে 'জয় বাংলা' স্লোগানটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকেই মানুষের মনের মধ্যে প্রবেশ করা সেই 'জয় বাংলা' স্লোগানটিকে মমতা ব্যানার্জি আঁকড়ে ধরলেন। এর ফলে ভারতের রাজনীতিতে নতুন সংকট সৃষ্টি হবে কি না- তা আগামীতে বলা যাবে।
ভারতব্যাপী ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী আধিপত্য বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির যে উন্মেষ হওয়ার দরকার ছিল তেমনটি ঘটেনি। কংগ্রেস, সিপিআইএম বা বামফ্রন্ট ধর্ম নিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিকভাবে সামনে নিয়ে আসতে পারেনি। ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশ্নে কংগ্রেস নানা কারণে বিতর্কিত হলেও পশ্চিমবাংলায় বামদের একটা অবস্থান ছিল। কিন্তু, আব্বাস সিদ্দিকীর আইএসএফ নিয়ে সংযুক্ত মোর্চা হিন্দুত্ববাদি রাজনীতির আধিপত্যের বিরুদ্ধে কতটুকু ভুমিকা রাখতে পারবে- তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসমাবেশ দেখে ভোটের হিসাব করা যাবে না। প্রায় ২৭ শতাংশ মুসলিম ভোটার এখন কোথায় সন্নিবেশিত হবে। কিছু তৃণমূল কংগেসে এবং কিছু সংযুক্ত মোর্চায়! যদি তাই হয়, তবে পশ্চিমবাংলায় মুসলিম ভোটের কর্তৃত্ব খর্ব হবে এবং বিজেপির ক্ষমতা গ্রহণের পথ সুগম হবে।
ভারতের ফেডারেল কাঠামোর সরকার ব্যবস্থার মধ্যে রাজ্যগুলোর সাথে দীর্ঘকাল কেন্দ্রের নানান সংকট। দক্ষিণ ভারত কিংবা মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমবাংলা এই তিন ভূখণ্ডেই সংকট বিদ্যমান। সেদিক থেকে 'জয় শ্রীরাম' শ্লোগানের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস গ্রহণ করেছে তা যথার্থ হবে কি না, বোঝা যাবে আগামী দিনগুলোতে। 'জয় শ্রীরাম' এর বিপক্ষে 'জয় বাংলা' আর 'জয় মহারাষ্ট্রা' এমনি সব স্লোগানে ভারতীয় ফেডারেল কাঠামোকে দুর্বল করবে। মহারাষ্ট্র ইতিমধ্যেই শিবসেনা নামক আরেকটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করেছে এবং বিজেপিকে কোণঠাসা করার লক্ষ্যে কংগ্রেস শিবসেনাকে সমর্থন করেছে। আসন্ন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের ফলাফলে যদি বিজেপি বিস্ময়কর কোন ফলাফল অর্জন করে তাহলে পশ্চিমবাংলায় নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে কংগ্রেস, সিপিএম ও আইএসএফ জোট 'সংযুক্ত মোর্চা' কি অবস্থান গ্রহণ করবে সেটা দেখার বিষয়। তবে এই নির্বাচন নিঃসন্দেহে ভারতকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ইতোমধ্যে, দুটি নির্বাচন সমীক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। প্রথমটিতে মমতা ব্যানার্জির দলের একটি শক্তিশালী অবস্থানের কথা বলা ছিল। কিন্তু, দ্বিতীয় সমীক্ষাতে বেশ খানিকটা পরিবর্তন ঘটেছে। ২৯৪+১ আসনের মধ্যে ১৫০ এর আশপাশ দেখিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং ১০০ কিছু বেশি দেখাচ্ছে বিজেপিকে আর কংগ্রেস- বামফ্রন্টকে ৫০টি আসনের কথা বলা হয়েছে। আগামী কয়েকদিনে হয়তো ব্যাপারটা আরেকটু পরিস্কার হবে। তবে এবারকার পশ্চিম বাংলার নির্বাচনের পরিণতি ভারতের ফেডারেল কাঠামো দুর্বল করবে কি না কিংবা পশ্চিম বাংলার মুসলিম সমাজ আবার নতুন হিন্দু আধিপত্যের আক্রমণের শিকার হবে কি না- সেটাই দেখার বিষয়। এ নির্বাচনে বিজেপির বিজয় অর্জন কি গুজরাট দাঙ্গার মতন কোন দাঙ্গা সৃষ্টি করবে কি না- তাও এখন গভীর উদ্বেগের বিষয়।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক