কোভিড-১৯ নিয়ে ‘অনির্ভরযোগ্য’ তথ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মহামারি প্রতিরোধের বৈশ্বিক প্রচেষ্টা
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/03/05/210228071441-turkmenistan-president-gurbanguly-berdymukhamedov-0603-file-exlarge-169.jpg)
গতবছর মহামারি হানা দেওয়ার পর থেকে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও মৃত্যুর সরকারি রেকর্ড বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'কে (হু) দিচ্ছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। অতিমারি আকারে ছড়িয়ে পড়া রোগটি প্রতিরোধের লড়াইয়ে এসব তথ্য অতি-প্রয়োজনীয়।
তবে তিনটি দেশ ছিল ব্যতিক্রম। সংক্রমণের তথ্য নিয়ে তাদের দেওয়া তথ্যে ছিল না কোনো স্বচ্ছতা, বরং বিশেষজ্ঞদের মতে এগুলো ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট দাবির ভিত্তিতে। এমনকি সমস্যার তীব্রতাকেও খাটো করে দেখাতে চেয়েছে বা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে দেশগুলো।
প্রথমেই বলা যাক পূর্ব আফ্রিকার দেশ তাঞ্জিনিয়ার কথা। গত বছরের মে'র পর তারা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তথ্য আপডেট করেনি। অর্থাৎ, তখন থেকে একই আছে সংক্রমণ ও মৃতের হার। দেশটির আনুষ্ঠানিক রেকর্ড অনুসারে মোট সংক্রমণ ৫০৯ এবং প্রাণহানির সংখ্যা ২১।
মধ্য এশিয়ার দেশ তুর্কমেনিস্তান- তো আরেক কাঠি সরেস। প্রবল স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় শাসিত দেশটি হু'র কাছে আজ পর্যন্ত কোনো সংক্রমণের তথ্য দেয়নি। তবে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, সরকারি পর্যায়ে যতোই নাকচ করা হোক, কোভিড-১৯ সংক্রমণ সেদেশে মারাত্নক আকার ধারণ করেছে।
শেষোক্ত রাষ্ট্রটি হলো; উত্তর কোরিয়া। এপর্যন্ত তারা কোনো সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি বলে দাবি করেছে। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ এই দাবি নিয়ে প্রচণ্ড সন্দিহান। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন দেশটি ২ কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যার অতি-সামান্য একটি অংশের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছে। অথচ, মহামারির উৎস দেশ চীনের সাথে রয়েছে তাদের সীমান্ত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উ. কোরিয়ায় বিপুল সংক্রমণ দেখা দেওয়ার কথা।
এব্যাপারে হু'র ইউরোপ শাখা অফিসের আঞ্চলিক জরুরি অবস্থা বিষয়ক পরিচালক ড. ডোরিট নিটজান বার্তা সংস্থা সিএনএন'কে বলেন, ১৪টি দেশ এপর্যন্ত শূন্য সংক্রমণ সংখ্যা রিপোর্ট করেছে, যা স্বতন্ত্রভাবে নিশ্চিত করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। তার মতে, "সত্যিকার অর্থেই এসব দেশে মহামারি ছড়ায়নি- নাকি তথ্য লুকানো হয়েছে- তা আমাদের পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।"
হু'র কোভিড তালিকায়- যেসব দেশ সংক্রমণের শূন্য সংখ্যা জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে যেসব দেশ কোনো তথ্যই জমা দেয়নি- তাদের আলাদা করে চিহ্নিত করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে তুর্কমেনিস্তান এবং উ. কোরিয়ার তুলনায়; শূন্য কেস সংখ্যা রিপোর্ট করা অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলগুলো আকারে বেশ ছোট ও প্রত্যন্ত। যেমন; সেন্ট হেলেনা, কিরিবাতি এবং টুভালুর মতো দ্বীপরাষ্ট্র।
"আমরা সকল দেশকে প্রকৃত তথ্য দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করছি- কারণ তার মাধ্যমে আমরা বৈশ্বিক পর্যায়ে রোগটির গতিবিধির উপর নজর রাখতে পারি। কোভিড-১৯ সংক্রামক রোগ হওয়ায়, কেস ট্র্যাক করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাতে জরুরি ভিত্তিতে যথাযথ স্বাস্থ্য বিষয়ক সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয়," নিটজান যোগ করেন।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2021/03/05/210203095041-file-02-john-magufuli-2020-exlarge-169.jpg)
তাঞ্জিনিয়ার প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলি বারংবার জীবাণুর হুমকি খাটো করে উপস্থাপন করেছেন। জনগণকে পরামর্শ দেন প্রার্থনার মাধ্যমে করোনাভাইরাস হঠাতে। এমনকি অবাস্তব ও অদ্ভুতূরে সব চিকিৎসা পদ্ধতির পরামর্শ দেন তিনি ও তার প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। ৫ কোটি ৮০ লাখ জনসংখ্যার জন্যে তিনি টিকা সংগ্রহের উদ্যোগও নেননি, বরং ফিরিয়ে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রস্তাব। কোভিড প্রতিষেধককে মাগুফুলি 'বিপজ্জনক' এবং 'আমাদের জন্যে অশুভ' বলেও উল্লেখ করেন।
তবে সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে তার সরকারের দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার মৃত্যু, মাগুফুলির দাবির অসারতা প্রকাশ করে। তাঞ্জিনিয়া আগের অবস্থান থেকে সরে আসছে, এমন ইঙ্গিতও মিলছে।
তাঞ্জিনিয়ার সবচেয়ে বড় শহর দার এস-সালামে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এক সতর্কবার্তায় জানিয়েছে, গত জানুয়ারির পর থেকে দেশটিতে সংক্রমণের হার মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। দেশটিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন যে, "সরকারি তথ্যের নির্ভরযোগ্যতার অভাবে তারা নিজস্ব উদ্যোগে সংক্রমণের তথ্য সংগ্রহ করছেন।" পাশপাশি তিনি দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের প্রতি ভ্যাকসিনের নির্ভরযোগ্যতা বিষয়ক তথ্যপ্রমাণ ক্ষতিয়ে দেখার অনুরোধ করেন।
এপ্রসঙ্গে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাঈদ বিজনেস স্কুল ইন ইংল্যান্ডের বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. পিটার ড্রোবাক বলেন, "মহামারির কারণে নেতৃত্বের গুণ এখন সামনে আসছে। অতিমারির মতো ভয়ঙ্কর হুমকি অস্বীকার করা নেতারা যে - একটি দেশের জন্য কতোটা বিপজ্জনক, এরফলে সেটা স্পষ্ট হয়। তারা বিপদ অস্বীকার করে প্রকৃত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় জনতাকে সংগঠিত করেন না"
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2021/03/05/210224085003-04-covid-tanzania-turkmenistan-north-korea-restricted-exlarge-169_1.jpg)
জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় নেতৃত্বের অদক্ষতা সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বদৌলতে হাড়েহাড়ে টের পায় যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হয়েও, শিকার হয় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির। মহামারি ধারণ করে সর্বনাশা রূপ। এখনও যার থাবা থেকে মুক্তি পায়নি দেশটির অনেক অঞ্চল। ট্রাম্পের মতোই ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেইর বলসোনারো ভাইরাসকে গ্রাহ্য করেননি শুরুতেই, ফলে সেখানেও মৃত্যুর মিছিল বাড়ে।
তবে শুধু জাতীয় পর্যায়েই নয়, জীবাণু প্রতিরোধের বৈশ্বিক চেষ্টার জন্য তথ্য রেকর্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছে, সকল দেশের মানুষকে অতি-সংক্রামক এই রোগের হাত থেকে মুক্তি দিতে হবে টিকাদানের মাধ্যমে। কিন্তু, যেসব দেশ তথ্য নিয়ে লুকোচুরি করে বা মহামারির প্রভাব মুক্ত বলে সরাসরি দাবি করে, সেখানে টিকাদান চালু করা তো অনেক পরের কথা।
ইতোমধ্যেই, অভিযোজনের কারণে অতি-সংক্রামক কিছু ধরন তৈরি হয়েছে করোনার। যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল ও দ. আফ্রিকার মতো দেশে অভিযোজিত ধরনগুলো আরও বেশি সংক্রামক। টিকাদানে যতবেশি সময় লাগবে এগুলো পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি ততোই বাড়বে। তৈরি হবে সংক্ষিপ্ততম সময়ে আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের প্রভাব কাটিয়ে ওঠায় সার্স কোভ-২ ভাইরাসের সক্ষমতা। ফলে অনিশ্চিতকাল জীবন ও জীবিকার বিপন্নতা সঙ্গী হবে পৃথিবীবাসীর।
- সূত্র: সিএনএন