বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে গেলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে
ক্ষমতায় এসেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত ২০ জানুয়ারি ডব্লিউএইচও থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিকভাবে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন নবনির্বাচিত এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে, করোনা মহামারি ও অন্যান্য বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতা, জরুরি সংস্কার না করা এবং ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক প্রভাব থেকে স্বাধীন হতে না পারার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউএইচও থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়াও আদেশে বলা হয়, সংস্থাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের 'অন্যায্য' পরিমাণে ভারসাম্যহীন অর্থপ্রদানও এ সিদ্ধান্তের কারণ। দেওয়া জাতিসংঘের সংস্থা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এত দিন অন্য দেশের তুলনায় সংস্থাটিকে 'অন্যায্য পরিমাণে' বেশি অর্থ দিয়েছে ওয়াশিংটন।
করোনা মহামারি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা নিয়ে বরাবরই ক্ষুব্ধ ছিলেন ট্রাম্প। মহামারির সময় ২০২০ সালের জুলাইয়ে তিনি সংস্থাটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
পরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করেন।
এমনকি বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ফের ডব্লিউএইচওকে সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন করা রাষ্ট্রের অবস্থান দখল করে। ২০২৩ সালে সংস্থাটির মোট বাজেটের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ডব্লিউএইচওর বার্ষিক বাজেট প্রায় ৬.৮ বিলিয়ন ডলার।
ডব্লিউএইচও থেকে কোনো সদস্য বেরিয়ে যেতে হলে জাতিসংঘকে এক বছরের নোটিশ দিতে হবে।
এই পদক্ষেপের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ১২ মাসের মধ্যে জাতিসংঘের স্বাস্থ্য সংস্থাটি থেকে বের হয়ে যাবে এবং সংস্থাটিকে দেওয়া সব ধরনের চাঁদা বন্ধ করে দেবে।
তবে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ কেউ আইনি চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একজন সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জকারী হতে পারেন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লরেন্স গোস্টিন।
তিনি এই সিদ্ধান্তকে 'বিপর্যয়কর' প্রেসিডেন্সিয়াল সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেছেন।
গোস্টিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য কংগ্রেসের অনুমোদনের প্রয়োজন, কারণ কংগ্রেসই প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রকে ডব্লিউএইচও-তে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৮ সালে ডব্লিউএইচও প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর একটি মূল অংশ ছিল। ঠিক যেমন এর আগে ১৯০২ সালে প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশনের (পিএএইচও) অন্যতম মূল স্তম্ভ ছিল দেশটি। পিএএইচও পরে ডব্লিউএইচও-তে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পশ্চিম গোলার্ধের (আমেরিকা এবং আশেপাশের দেশগুলো) জন্য নিবেদিত একটি শাখা হিসেবে কাজ শুরু করে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ডব্লিউএইচও -কে ১.৩ বিলিয়ন ডলার দেয়। তবে এই অর্থের বেশিরভাগই তার নির্দিষ্ট প্রোগ্রামগুলোর জন্য বরাদ্দ থাকে। যেমন- 'পোলিও' বা আমেরিকা বরাদ্দ দিতে ইচ্ছুক যে কোনো 'জরুরি স্বাস্থ্য সমস্যা'।
তবে ২০২৫ সালের জন্য সংস্থাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত অবদান মাত্র ২১৮ মিলিয়ন ডলার, যা আমেরিকার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ের ক্ষুদ্র একটি অংশ মাত্র।
ডব্লিউএইচও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) এবং জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটগুলির মতো আমেরিকান সংস্থাগুলোর সঙ্গেও সহযোগিতা করে।
করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার সময় ডব্লিউএইচও যে নির্দেশিকা দিয়েছিল, সেটি চীনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল বলে অভিযোগ তুলেছিলেন ট্রাম্প।
জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর অনুরোধে একটি স্বাধীন তদন্তে দেখা গেছে, ডব্লিউিএইচও কোভিড-১৯ মহামারিকে জরুরি স্বাস্থ্য সংকট হিসেবে ঘোষণা করতে দেরি করেছে। এছাড়া, সংস্থাটি যেসব আন্তর্জাতিক সতর্কতা ব্যবস্থা নিয়েছিল, সেগুলোও ছিল যথেষ্ট ধীরগতির।
তদন্তে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস ছিল অনেক দেশের জন্য একটি 'স্বজন হারানোর মাস'—যুক্তরাষ্ট্রও এর ব্যতিক্রম নয়। সারা পৃথিবীর স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছিল।
আরও বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির শুরুর দিকে এই ভাইরাসের গুরুতরতা নিয়ে হালকা মন্তব্য করায় তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ব্যাপক সমালোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি, জাতীয় পরীক্ষার কৌশল বা কোনো জাতীয় কৌশলই বাস্তবায়ন করতে তিনি ব্যর্থ হন।
তার প্রশাসন আরও একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছিল। তারা মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)-কে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নামের একটি ওষুধের অনুমোদন দিতে চাপ দিয়েছিল, যদিও এই ওষুধের কার্যকারিতার প্রমাণ ছিল খুবই দুর্বল। পরে জানা যায়, এই ওষুধ ব্যবহারের কারণে ৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন। তারা সতর্ক করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউএইচও থেকে বেরিয়ে গেলে মার্কিনীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
অনেকে মনে করছেন, এই পদক্ষেপের ফলে ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ও এইচআইভি-এইডসের মতো সংক্রামক রোগ মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা পিছিয়ে যেতে পারে।
বাইডেনের অধীনে করোনা মোকাবিলার সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করা ড. আশীষ ঝা এর আগে সতর্ক করে বলেছেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত কেবল সারা বিশ্বর মানুষের স্বাস্থ্যকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, বরং বৈশ্বিক নেতৃত্ব ও বৈজ্ঞানিক দক্ষতাকেও দুর্বল করবে।'