আরেক রাজবধুর মুক্ত হওয়ার লড়াই
প্রিন্সেস ডায়ানার শেষকৃত্যের কথা যাদের মনে আছে, তারা নিশ্চয়ই ছোট্ট উইলিয়াম আর হ্যারির কথাও মনে রেখেছেন। ১৯৯৭ সালে মায়ের কফিনের পিছে মাথা নিচু করে গুটিসুটি হাঁটছিল দুই রাজপুত্র। করুণ দু'জোড়া চোখ নিয়ে হাত দুটো সামনে জড়ো করে এগিয়ে চলছিল। ডায়ানার কফিন তখন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে নেওয়া হচ্ছিল। স্যুট পরিহিত জড়সড় হ্যারিকে একটু বেশিই ছোট দেখাচ্ছিল।
এত বছরে এই ছবি ঘুরেফিরে বারবার চোখের সামনে এসে থাকবে। দুই রাজপুত্রের ট্রমা জড়িত শৈশবের স্মৃতিচিহ্ন এই চিত্র। রোববার অপরাহ উইনফ্রের সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারের সাথে দুঃসহ সেই অতীত যেন আবারও হানা দিল।
ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো মেগানকে ডাচেস অব উইন্ডসর ওয়ালিসের মতোই নেতিবাচক চরিত্রে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে। ওয়ালিস ছিলেন একজন আমেরিকান ডিভোর্সি নারী। ১৯৩৬ সালে রাজার সাথে প্রণয়ের সূত্র ধরে, ওয়ালিসকে বাকি জীবন তিক্ত এক নির্বাসনে কাটাতে হয়। সেই ঘটনাতেও পারিবারিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। ডায়ানার চেয়ে সম্ভবত ওয়ালিসের সাথেই মেগানের বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।
হ্যারি প্রায়ই ডায়ানার সাথে ঘটে যাওয়া অতীত নিয়ে দুঃখ এবং তিক্ততার কথা ব্যক্ত করেছেন। প্রিন্স চার্লসের সাথে ডিভোর্সের পর রাজপরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং শেষ অবধি পাপারাজ্জিদের তাড়ায় প্যারিসে হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু; রোববার আবারও হ্যারি এই প্রসঙ্গ তুললেন। হ্যারির বক্তব্য অনুযায়ী, মায়ের মতো স্ত্রীও একই অভিজ্ঞতার শিকার। তিনি এও জানান যে, মেগানের সাথে পুরো ঘটনায় তিনি তার মায়ের উপস্থিতিই যেন টের পাচ্ছিলেন।
শুনতে শেক্সপিয়ারের কাহিনীর মতোই মনে হবে। অভিশপ্ত রাজপরিবারের অতীত যেন কেবল নিজের পুনরাবৃত্তিই দেখতে চায় । শুধু পার্থক্য এই যে, এবার এক রাজপুত্র পুরোনো সেই পরিক্রমা ভেঙ্গে নতুন পথ খুঁজে নিয়েছেন।
রোববার হ্যারি যেন এই তুলনার বিষয়টি খোলাখুলিই তুলে ধরলেন। তিনি স্ত্রী মেগানের প্রতি অবিরাম সমালোচনা ও বর্ণবাদী আক্রমণের অভিযোগ তুলেন।
"আমি দেখছিলাম যে ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি করছে," বলেন হ্যারি। তবে তিনি মনে করেন, মেগানের প্রতি আচরণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বর্ণবাদী উপাদানের কারণে 'আরও বেশি ভয়াবহ' ছিল।
সাক্ষাৎকারে রাজবধূ হিসেবে মেগানের মানসিক সংকট, একাকীত্ব এবং আত্মহত্যা প্রবণতার কথাগুলো যেন, ডায়ানার বুলিমিয়া এবং হতাশার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এমনকি মেগানের মতো ডায়ানাও বলেছিলেন যে, রাজপরিবারের কাছে সাহায্য চেয়েও কোনও সহায়তা পাননি তারা।
হ্যারি বলেন, "আমি যখন ইতিহাস পুনরাবৃত্তির কথা বলি, তখন মায়ের বিষয়েই বলি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলে, যে কেউ সাহায্য চাইবে।"
কিন্তু, মায়ের মতো মেগানও যখন সাহায্য প্রার্থনা করেন তখন কেউ এগিয়ে আসেনি। উল্টো রাজপরিবার মেগানের উদ্বেগের বিষয়টি উড়িয়ে দেয় এবং তাকে শান্ত থাকার উপদেশ দেওয়া হয়।
এই যুগলকে বারবার বলা হত- "এমনই হয়। এটি ঠিক এমনই হয়," বলেন হ্যারি।
মেগান এবং ডায়ানার মাঝে বেশ কিছু মিল আছে।
ডায়ানার মত মেগানেরও এমনই পরিবারে বিয়ে হয়, যারা তাদের কখনোই বুঝতে পারেনি। দুজনের ক্ষেত্রেই ধরা হয়েছিল যে, তারা রাজ রীতিনীতি ও নিয়মকানুন বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিবেন। তারা যখন রাজপরিবারের সাথে তাল মেলাতে ব্যর্থ হলেন, তখন লোকমুখে ছড়াতে থাকল যে এই দুই রাজবধূই উন্নাসিক, চাহিদাসম্পন্ন আর অহংকারী। অথচ, রাজপরিবার এসব গায়েই মাখল না।
ডায়ানার মত মেগানের পিছেও ট্যাবলয়েডগুলো লেগে ছিল। ট্যাবলয়েডগুলোতে বারবার তাদের বিরুদ্ধে 'দৃষ্টি আকর্ষণ চেষ্টার' অভিযোগ আনা হয়। অথচ, এই প্রিন্সেসদের নিয়ে লিখেই ট্যাবলয়েডগুলো তাদের পাতার পর পাতার রসদ যোগাচ্ছিল।
তবে মেগান আর ডায়ানার মধ্যে পার্থক্যও আছে। ডায়ানা ছিলেন শ্বেতাঙ্গ, অন্যদিকে মেগান মিশ্রবর্ণের। ডায়ানার বিবাহ–বিচ্ছেদ হলেও, মেগানের দৃঢ় এক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ আছেন। সেই সাথে পাচ্ছেন হ্যারির অবাধ সমর্থন।
চার্লসের সাথে যখন ডায়ানার বিয়ে হয়েছিল, তখন তার বয়স মাত্র কুড়ি। রক্ষণশীল ভাবে বেড়ে উঠা ডায়ানা ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল। মেগানের বয়স এখন ৩৬। তিনি নিজের বক্তব্য সামনে রাখতে জানেন। হ্যারির সাথে বিয়ের সময় মেগান ছিলেন ডিভোর্সি এবং একজন সফল অভিনেত্রী।
সেইসাথে, মেগান একজন আমেরিকান। তার মাঝে আছে আমেরিকান চিন্তাধারা এবং সংবেদনশীলতা।
ডায়ানা এমন এক সংস্কৃতি থেকে এসেছেন যেখানে সংযম এবং ঐতিহ্য রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। মেগানের সংস্কৃতিতে সাহায্য প্রার্থনা, নিজের অনুভূতি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা স্বাভাবিক বিষয়। অবস্থার অনুকূলে নতুনত্বকে গ্রহণ এখানে সমাদৃত।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস