বাংলাদেশ: নারী যেখানে রাজনীতি আর কর্মস্থলে সক্রিয়, পিছিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে
দক্ষিণ এশিয়ায় নারী ক্ষমতায়নের নানা সূচকে প্রতিবেশীদের তুলনায় এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশি নারী সাংবাদিক সাদিয়া রহমান ভারতের প্রসিদ্ধ গণমাধ্যম স্ক্রল ডটইন- এ প্রকাশিত তার লেখায় এদেশের নারী অগ্রগতির নানা অর্জন এবং মহামারিতে তাদের প্রভাবিত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন। প্রতিবেদনটি অবলম্বনে তার বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো:
মহামারি তাড়িত বিশ্বে প্রায় সকল দেশের অর্থনীতি টিকে থাকার সংগ্রামে ব্যস্ত, যার কারণে মানব উন্নয়নের অনেক অর্জন উল্টোপথে চলেছে, অর্থাৎ অগ্রগতির জায়গায় দেখা দিয়েছে পশ্চাদসরণ। গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাই এবছরে জাতিসংঘ নির্ধারিত প্রতিপাদ্য ছিল- "নারী নেতৃত্ব: কোভিড-১৯ প্রভাবিত বিশ্বে বৈষম্যহীন ভবিষ্যৎ অর্জন।"
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আনুষ্ঠানিক ওয়েবসাইটে এবছরের প্রচারণার প্রতিপাদ্য ছিল প্রথাগত বৈষম্যকে মোকাবিলায় 'চুজ টু চ্যালেঞ্জ' শিরোনামে।
প্রথম প্রতিপাদ্যে নারীকে নেতৃত্বস্থানে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রাখা হয়েছে, আর দ্বিতীয়টির লক্ষ্য লিঙ্গ পরিচয় ঘিরে সমাজের অমূলক ধ্যানধারণা, বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করে সেখানে নারীর উন্নয়ন সহযোগী পরিবেশ তৈরি।
তবে দুটি প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য একই, তা হলো; নারীকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা করে দেওয়া।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হওয়ার তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এমতাবস্থায় এদেশের জন্যে নারী ক্ষমতায়নের তাৎপর্য কী? – সেটাই আজকের আলোচনায় বিষয়।
নারীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব:
কয়েক দশকের বেশি সময় ধরে নারী নেতৃত্বে শাসিত হচ্ছে বাংলাদেশ। খোদ প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রধানেরাও নারী। পৃথিবী জুড়ে বাংলাদেশের পরিচিতি তৈরি পোশাক রপ্তানির কারণে- সেই অর্জন এসেছে নারী শ্রমিকদের রক্তজল করা পরিশ্রমের বিনিময়ে।
এসব প্রেক্ষিতে মনে হতেই পারে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন করা খুবই সহজ। কিন্তু, সেটা কি প্রকৃত বাস্তবতা?
সরলভাবে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়ে ওঠার সক্ষমতা বোঝানো হয়, যার মাধ্যমে কোনো কিছুর অভাব কাটিয়ে উঠা যায় এবং নিজের জীবনের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করা যায়। ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ নানা আসনে থেকেও, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশকে পরিচিত করাতে অবদান রেখেও, বাংলাদেশি নারীরা কী সেভাবে তাদের নিজের জীবনকে নিয়ে- ভালোমন্দ বিচারের স্বাধীনতা বা কর্তৃত্ব পেয়েছেন?
বর্তমান পরিবেশ কী নারীর সংগ্রাম এবং অর্জন ধারনের সহযোগী?
বিশ্লেষণটি রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করলে দেখা যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে একজন নারী হলেও- তৃণমূল পর্যায়ের নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলররা দীর্ঘদিন ধরেই তাদের পুরুষ প্রতিপক্ষের তুলনায় কম গুরুত্ব পাওয়ার অভিযোগ করে আসছেন।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের এমন এক নারী কাউন্সিলর হলেন আলেয়া সারোয়ার ডেইজি। তিনি অভিযোগ করেন, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তার মতামত তো দূরের কথা- পুরুষ সহকর্মীরা তাকে সামান্য জন্মসনদ ইস্যু করার মতো দায়িত্বও পালন করতে দেন না। এসব ঘটনা নিরুৎসাহিত করছে নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ।
সমতা ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য দরকার কর্মী বাহিনীতে সুষম অংশগ্রহণ- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো'র শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৬-১৭) এখাতে কিছুটা আলোকপাত করে।
সমীক্ষায় দেখা যায় দেশে মোট কর্মী আছে ৬ কোটি, যাদের ১ কোটি ৮৬ লাখ নারী। কিন্তু, তাদের মধ্যে আবার মাত্র ৮.২ শতাংশ কর্মরত প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। অন্যদিকে, জাতীয় পর্যায়ে ১৭.৯ শতাংশ পুরুষ কাজের সুযোগ পাচ্ছেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত মানেই কর্মীর জীবিকা ও অন্যান্য অধিকার রক্ষায় আইনি সুরক্ষার অভাব।
দেশের বিখ্যাত পোশাক শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩২ লাখ নারীর। এতথ্য জানা গেছে পোশাক প্রস্তুতকারক কারখানা মালিক ও রপ্তানিকারকদের জোট- বিজিএমইএ সূত্রে। এই নারীরা দেশের মোট জিডিপি'র একটি বড় অংশ অর্জনে অবদান রাখলেও, তারা বিপন্ন এক জীবন-যাপন করেন। করোনা মহামারি যা আরও নাজুক করে তুলেছে।
অনিশ্চিত কর্মসংস্থান:
কোভিড-১৯ বিস্তার রোধে বাংলাদেশ জুড়ে চালু হয় জাতীয় লকডাউন। তখন থেকে বাতিল বা স্থগিত হয়েছে বিদেশি ক্রেতা ব্র্যান্ডের অনেক অর্ডার। গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের মহাসচিব জুলি তালুকদার জানান, মহামারির অজুহাতে গার্মেন্টস মালিকেরা বকেয়া বেতনভাতা পরিশোধ না করেই শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। অথচ এই বেতনভাতার চাপ দিয়েই তারা সরকারের কাছ থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ আদায় করে নেয়।
এখন স্থগিত হওয়া কিছু অর্ডার সচল হয়েছে, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার পরিমাণও বেড়েছে। তারপরও, গার্মেন্টস মালিকেরা পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মী নিয়োগ দিতে দ্বিধা করছেন। উল্টো স্বল্প সংখ্যক কর্মীকেই চাকরিচ্যুতির ভয় দেখিয়ে, তাদের দিয়ে বাড়তি কাজ করাচ্ছেন বলেও জানান জলি তালুকদার।
তিনি বলেন, "ওভারটাইম কাজ করতে বললে শ্রমিকদের পক্ষে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিছু হলেই চাকরি থাকে না। একে কারখানার কাজ আবার নারী শ্রমিককে বাড়ি ফিরে গৃহস্থালি কাজও করতে হয়। কারখানা ও বাড়িতে এভাবে একটানা কাজ করার ফলে তাদের শরীর ও মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ছে।"
সোজা কথায়, দেশের সবচেয়ে মূল্যবান কর্মী-সম্পদ পোশাক শ্রমিকরা হচ্ছেন শোষণের শিকার। কর্মস্থলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে মহামারির বিপদ।
বিপাকে পড়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারীরাও। তাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে অসম বেতনের অপমান। এছাড়া, ১২.৭ শতাংশ বাংলাদেশি নারী কর্মী কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে সম্প্রতি কর্মজীবী নারী এবং কেয়ার বাংলাদেশের এক গবেষণায় উঠে আসে।
ক্ষমতায়নের সমুজ্জ্বল নমুনা নয় এ চিত্র।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেক উৎস প্রবাসী আয়। মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু দেশে নারী কর্মী পাঠিয়েছে বাংলাদেশ।
এসব নারীরা বিদেশ যায় ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন বুকে নিয়ে। কিন্তু, প্রান্তিক এসব নারী সেখানে গিয়ে নানা রকম নির্যাতন ও সহিংতার শিকার হন। ২০১৬ সাল থেকে ৪৭৩ জন বাংলাদেশি প্রবাসী নারীর মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল এমন পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা।
দেশের পথেঘাটে বা নিজ বাড়িতেও কি নারী নিরাপদ? গত পাঁচ বছরে ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২৬,৬৯৫টি। অনেক ঘটনায় মামলা হয়নি সমাজপতিদের চাপে বা নারীর আর্থ-সামাজিক অসহায়তার কারণে।
মহামারিতে এই পরিস্থিতি যেন আরও নাজুক হয়। দেশে বেড়েছে গৃহস্থালি নির্যাতনে এবং ধর্ষণের ঘটনা। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অভাবগ্রস্ত অনেক অভিভাবক কন্যা শিশুর বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন আশঙ্কাজনক হারে।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীকে অন্তর্ভুক্ত করার সরকারি চেষ্টা সত্ত্বেও, সাম্প্রতিক আরেক জরিপে দেখা গেছে, লিঙ্গ বৈষম্য কমানোর জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে 'তুলনামূলক দুর্বল' অগ্রগতির পর্যায়ে আছে বাংলাদেশ। তবে ওই একই সমীক্ষার প্রতিবেদনে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
পরিশেষে বলা যায়, আগামী দিনে আর্থ-সামাজিক পরিসরের সকল স্তরে নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো ক্ষমতায়নে বাংলাদেশকেও চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
- সূত্র: স্ক্রল ডটইন অবলম্বনে
- লেখক: ঢাকা ভিত্তিক সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী