জিরো ট্যারিফ: বাংলাদেশের রোডম্যাপে শিক্ষা, শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে ইইউ অসন্তুষ্ট
অস্ত্র বাদে সকল পণ্যে জিরো-ট্যারিফ সুবিধা বহাল রাখতে শ্রম পরিস্থিতি উন্নয়নে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশ যে রোডম্যাপ পাঠিয়েছে তাতে ইউরোপীয় কমিশনের কর্মকর্তারা 'সিরিয়াস ফ্রাস্ট্রেশন এন্ড কনসার্ন' প্রকাশ করেছেন বলে পররাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে ব্রাসেলস দূতাবাস।
দেশে শ্রম পরিস্থিতি উন্নয়নে ইইউ এর দেওয়া ৯ দফা এ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নে সরকারের তৈরি করা রোডম্যাপ ও তা বাস্তবায়ন পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে দেশের রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় এই বাজারটিতে ২০২৩ সালের পর বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত সুবিধা বহাল থাকবে কি-না।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাহবুব হাসান সালেহ এর সঙ্গে এক ভার্চুয়াল মিটিংয়ে বাংলাদেশের পাঠানো রোডম্যাপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ইউরোপীয় কমিশনের ডিরেক্টরেট জেনারেল ফর ইমপ্লয়মেন্ট, সোশ্যাল এ্যাফেয়ার্স এন্ড ইনক্লুসন (ডিজি-ইমপ্লয়মেন্ট) জর্ডি কারেল। মিটিংয়ে সংস্থাটির পলিসি অফিসার বুয়েনার বেনেডিক্ট, ইন্টারন্যাশনাল ইস্যুস এর হেড অব ইউনিট লুইস প্র্যাটস ও ব্রাসেলসে নিযুক্ত বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর মোঃ সফিউল আযম সংযুক্ত ছিলেন।
২৮ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক ইমেইলে ওই মিটিংয়ের কথা উল্লেখ করে মোঃ সফিউল আযম বলেছেন, 'কারেল রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনার সময় বিশেষত তিনটি বিষয়ে জোর দেন- আইএলও কনভেনশনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইপিজেড সংস্কার/ শ্রম মান, সকল ধরনের শিশু শ্রম নির্মূল এবং শিক্ষা'।
তিনি আরও যোগ করেন, 'আলোচনা চলাকালীন, জর্ডি শিক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন-রোডম্যাপের অন্যতম উপাদান হলেও যা এখন আর বাংলাদেশের অগ্রাধিকার হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে না'।
বিদ্যমান 'এভ্রিথিং বাট আর্মস' (ইবিএ) উদ্যোগটির মেয়াদ ২০২৩ সালে শেষ হবে এবং দেশটির অর্ধেকেরও বেশি রপ্তানি গন্তব্যকে পর্যালোচনা করে ইইউ বাংলাদেশের শ্রম মান এবং মানবাধিকার পরিস্থিতিকে পরবর্তী পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা করছে।
নতুন ইবিএ পাওয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন শ্রম আইন সংশোধন, ইপিজেড লেবার এ্যাক্ট সংশোধন, সকলখাতে শিশু শ্রম নিরসন, শ্রম আদালতে ঝুলে থাকা মামলা নিষ্পত্তিসহ ৯ দফা এ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের রোডম্যাপ গত নভেম্বরে দাখিল করেছে বাংলাদেশ।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, শিশু শ্রম নিরসন বিষয়ক এ্যাকশন প্ল্যানে 'স্কুল পার্টিসিপেশন এন্ড কোয়ালিটি অব স্কুল' শীর্ষক একটি পয়েন্ট রেখেছিল ইইউ। তাতে শতভাগ শিশুর প্রাইমারিতে ইনরোলমেন্ট নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাইমারি শিক্ষার মান ও স্কুলের মান নিশ্চিত করার বিষয়ে রোডম্যাপ চেয়েছিল ইইউ। এই পয়েন্ট বাস্তবায়নে রোডম্যাপে প্রাইমারি শিক্ষা নিয়ে সরকারের চলমান বিভিন্ন কর্মসূচির কথা তুলে ধরে কার্যত তা এড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ।
এতে সন্তুষ্ট হতে পারেননি ইইউ কর্মকর্তারা। তারা মনে করছেন, শতভাগ ইনরোলমেন্ট ও প্রাইমারি পর্যায়ে কোয়ালিটি শিক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে শিশু শ্রম নিরসন সম্ভব হবে না। ইইউ এর হতাশার প্রেক্ষিতে ৯ দফা এ্যাকশন প্ল্যান মোতাবেক 'স্কুল পার্টিশিপেশন ও কোয়ালিটি অব স্কুল' নিশ্চিত করা নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি ফর্মুলা প্রণয়ণের সুপারিশ করেছে ব্রাসেলসের বাংলাদেশ দূতাবাস।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ইউরোপীয় ইউনিয়ন শতভাগ প্রাইমারি ইনরোলমেন্ট বা শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান উন্নয়নের রোডম্যাপ চেয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেদের মতো করে এটি অর্জন করবো এবং তা অবশ্যই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার'।
'তারা আমাদের ২০০ বছর নির্যাতন করে, শোষণ করে তাদেরকে উন্নত করেছে, তাদের দেশে শিক্ষার মানোন্নয়ন করেছে। এখন তারা অন্য দেশকে তাদের মতো হতে বলছে। এটা এখন সম্ভব নয়। কারণ, তাদের মতো আমাদের কোন কলোনি নেই, আমরা কোন কলোনি চাইও না। আমরা রক্ত পানি করে গার্মেন্টস তৈরি করি, ফসল উৎপাদন করে রপ্তানি করি। আমরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী যতোটা সম্ভব করব, তবে তা অবশ্যই সময়সাপেক্ষ'- যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে শ্রম সচিব মো. আবদুস সালাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ইইউ আমাদের শিশুশ্রম নিরসন করতে বলেছে, সেটি আমরা করবো। কিন্তু তারা বলেছে যে, শুধু শিশু শ্রম নিরসন করলেই হবে না, শতভাগ শিশুর প্রাইমারিতে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের জন্য কোয়ালিটি শিক্ষা ও কোয়ালিটি স্কুল নিশ্চিত করতে হবে'।
'শ্রম মন্ত্রণালয় শিক্ষা নিয়ে কোন রোডম্যাপ করতে পারে না। আর, আমরা একটা রোডম্যাপ করে দেওয়ার পর, সে মোতাবেক কাজ না হলে তার জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়কে দায়ী করা হবে। তাই আমরা শিক্ষা নিয়ে রোডম্যাপে কোন পরিকল্পনার কথা জানাইনি। শিক্ষার বিস্তারে সরকারের যেসব উদ্যোগ রয়েছে, সেগুলো রোডম্যাপে তুলে ধরেছি'- যোগ করেন তিনি।
আবদুস সালাম বলেন, ইবিএ ও ইইউর দেওয়া এ্যাকশন প্লান বাস্তবায়ন নিয়ে মধ্যস্ততার চেষ্টা চলছে। সেখানে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়েও আলোচনা হবে। তখন প্রয়োজনে ইউনিসেফের সহায়তায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কনভেনশন অনুযায়ী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন ও সিবিএ করার অধিকার নিশ্চিত করে ইপিজেড লেবার ল' সংশোধন করতে বলেছে ইইউ। রোডম্যাপে বাংলাদেশ এ বিষয়ে কোন প্রতিশ্রুতি দেয়নি, বরং বিদ্যমান ইপিজেড আইনেই সেখানকার শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত।