অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ‘নিরাপদ ও কার্যকর', ইউরোপের দেশগুলোতে ফের টিকাদান শুরু
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্য ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (ইএমএ) যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং ব্রিটিশ-সুইডিশ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা পিএলসি কর্তৃক যৌথভাবে উদ্ভাবিত কোভিড-১৯ টিকাকে 'নিরাপদ ও কার্যকর' বলে ঘোষণা দিয়েছে। তারা আরও একবার জানিয়েছে, এই টিকার সঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধার উচ্চ ঝুঁকির কোনো সম্পর্ক নেই।
এ ঘোষণায় আশ্বস্ত হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতৃত্বস্থানীয় দেশগুলো অবশেষে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত করোনার টিকার প্রয়োগ ফের শুরু করছে।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় ঝুঁকির চেয়ে উপকার অনেক বেশি বলে গতকাল জানায় ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি (ইএমএ)। এরপরই টিকাদান কর্মসূচী আবারও শুরু করার ঘোষণা দেয় জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল এবং নেদারল্যান্ডস।
গত সপ্তাহে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কায় অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের প্রয়োগ স্থগিতের ঘোষণা দেয়। সে তালিকায় ছিল সুইডেন, স্লোভেনিয়া, লাটভিয়া, স্পেন, লুক্সেমবার্গ, ইন্দোনেশিয়া, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, বুলগেরিয়া এবং গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো প্রভৃতি দেশ।
তাদের এমন ঘোষণায় সামগ্রিকভাবে ইউরোপে টিকাদান কার্যক্রম বিলম্বের মুখে পড়ে।
আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের তুলনায় ইইউ'র দেশগুলো টিকাদানে পিছিয়ে ছিল। সম্প্রতি দেশে দেশে রক্ত জমাট বাঁধার খবর ছড়িয়ে পড়লে ইইউ অঞ্চলে টিকাদান পরিস্থিতি আবারও বিলম্ব এবং অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা এক বিবৃতিতে জানায়, ইএমএ'র এই ঘোষণা এবং ব্রিটিশ স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের অনুরূপ রায় আসার পর এই ভ্যাকসিনের সুবিধাগুলো নিয়ে আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকছে না।
সংস্থাটির চীফ মেডিক্যাল অফিসার অ্যান টেলর বলেছেন, "উভয় নিয়ামক কর্তৃপক্ষের ঘোষিত সিদ্ধান্তের পর ইউরোপের দেশগুলোতে আবারও টিকাদান কর্মসূচী পূর্ণ উদ্যেমে চালু হবে বলেই আশা করছি"।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি এবং জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেনস স্পান শুক্রবার থেকেই নিজ নিজ দেশে টিকাপ্রদান ফের শুরুর কথা জানিয়েছেন।
কানাডা এবং মেক্সিকোও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের চার মিলিয়ন ডোজ গ্রহণের আলোচনা ফের শুরু করেছে।
ভ্যাকসিনের নতুন স্ট্রেইনের ঝুঁকির জন্য ইউরোপে অতিসত্ত্বর ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু করা দরকার বলে মত বিশেষজ্ঞদের। ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জ্যঁ ক্যাসটেক্স গতকাল করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় প্যারিসসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আংশিক লকডাউন জারি করেন।
ইএমএ'র ঘোষণায় ইউরোপীয়দের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। যারা ইতিমধ্যে এক ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন, স্বাভাবিকভাবেই নতুন সিদ্ধান্তে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু যারা এখনো ভ্যাকসিন নেননি, তারা তাড়াহুড়ো না করে আরও গভীর অনুসন্ধানের আহবান জানান।
এমনই একজন প্যারিসের বাসিন্দা করিন গ্রিলোট বলেন, "তারা এতবেশি গোলমেলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, এতবার নিজেদের মত বদলাচ্ছে যে মানুষ এখন বুঝতেই পারছে না ঠিক কী করবে"।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আরেকবার মনে করিয়েছেন যে, রক্ত জমাট বাঁধার একাধিক কারণ রয়েছে। শুধু অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন গ্রহীতারাই নন, অন্য সংস্থা কর্তৃক উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন গ্রহণকারীদের মাঝেও স্বাস্থ্যগত কারণে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। কখনো কোন ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে, জন্ম বিরতিকরণ পিল গ্রহণও রক্ত জমাট বাঁধায় অবদান রাখে।
এদিকে ইএমএ'র সুরক্ষা কমিটির সভাপতি ডা. সাবিন স্ট্রস উল্লেখ করেন, যেসকল টিকা গ্রহীতার দেহে রক্ত জমাট বাঁধার লক্ষণ দেখা যায় তাদের মাঝে অনেকেই ছিলেন তরুণী ।
ইএমএর নির্বাহী পরিচালক ইমার কুক জানান, যেসব টিকা গ্রহীতার রক্ত জমাট বাঁধার অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাদের আরও বিস্তারিত স্বাস্থ্যগত তদন্ত হওয়া দরকার।
তবে ভ্যাকসিনের সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দিনদিন বেড়ে চলেছে বলেও অনেকে সতর্ক করেছেন। গত রবিবার অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন গ্রহণের পর থেকে মাদ্রিদের লুসিয়া এজার্কের (২৫) দু'দিন যাবত তীব্র জ্বর ও মাথাব্যথা ছিল। যে বাহুতে টিকা নেন, সেটিও ব্যথায় ফুলে ওঠে।
এ ব্যাপারে ইএমএ এর পরামর্শ, টিকা গ্রহনের পর কী কী করণীয় সে বিষয়ে দেশগুলোর প্রচার বাড়ানো উচিত।
এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ৭০ লাখ এবং যুক্তরাষ্ট্রের এক কোটি দশ লাখ মানুষ এই ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে ইমার কুক বলেন, 'নিঃসন্দেহে এটি বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহৃত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন"।
গত সোমবার জার্মানির ভ্যাকসিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা পল এহরলিচ ইনস্টিটিউট, অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন প্রদান স্থগিতের সুপারিশ করার পর রক্ত জমাট বাঁধার তদন্ত অনেকটা অবধারিতই হয়ে উঠে।
ইনস্টিটিউটের সভাপতি ক্লাউস সিচুটেক এই সুপারিশের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন, তাদের কাছে সেরেব্রাল ভেইন থ্রমবোসিসের সাতটি, মস্তিষ্কের গুরুতর অবস্থার একটি এবং মানুষের মৃত্যুর তিনটি খবর এসেছে।
ফলে জার্মানির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেয়া বন্ধ করে দেয় তখন। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিবিসিকে তখন জানান যে, এটি কোন 'রাজনৈতিক' সিদ্ধান্ত নয়।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্য বরাবরই এই ভ্যাকসিনের ওপর তাদের আস্থা বজায় আছে বলে জানিয়েছে। এখানেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের সহায়তায় এই ভ্যাকসিন প্রথম উৎপত্তি লাভ করে। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়াই ভ্যাকসিনের ব্যবহার স্থগিত করার জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর সমালোচনাও করেছেন।
এখন ভ্যাকসিনের প্রয়োগ স্থগিতকারী ইউরোপীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নিজেদের সিদ্ধান্তের সমর্থনে বলছে, এটি নিছকই 'পূর্বসতর্কতামূলক পদক্ষেপ' ছিল।
প্রসঙ্গত, আগে থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচ) বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রয়োগ চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানিয়ে আসছে।
সংস্থাটির মুখপাত্র ক্রিস্টিয়ান লিন্ডমেয়ার ইতিপূর্বে বলেছেন, রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা তারা খতিয়ে দেখছেন। তিনি আরও বলেন, " আজ পর্যন্ত এসব ঘটনার সাথে টিকার কোন সম্পর্ক পাওয়া যায়নি এবং ভাইরাস ও গুরুতর রোগ থেকে রক্ষা ও জীবন বাঁচানোর জন্য টিকা দেয়া অব্যাহত রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ"।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল অবলম্বনে