মেঘনায় ডুবোচরে আটকা পড়ছে নৌযান, ভোগান্তিতে যাত্রীরা
নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ-উপজেলা হাতিয়া যার আয়তন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার। দ্বীপটির উত্তরে জেলা শহর, পূর্বে মেঘনা নদী, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও পশ্চিমে ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলা। প্রায় সাত লাখ লোকের বসবাস এ দ্বীপটিতে। জেলা সদর থেকে সড়ক পথে ৫০ কিলোমিটার পথ অতিবাহিত করে নৌপথে যেতে হয় আরও প্রায় ২৭ কিলোমিটার। এ দ্বীপের জনগনকে জেলা তথা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করতে হয় নৌপথে।
ঢাকা-হাতিয়া, চট্টগ্রাম-হাতিয়া এবং নলচিরা (হাতিয়া)-চেয়ারম্যানঘাট (জেলা শহর থেকে আসার ঘাট) রুটে প্রতিদিন নৌপথে যাতায়াত করে হাজার হাজার যাত্রী। গত ৬-৭ মাস ধরে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নৌপথে চলাচলকারী এ যাত্রীদের। নদীতে নাব্যতা সংকটের কারণে সৃষ্টি হওয়া ডুবোচরে প্রতিনিয়ত আটকা পড়ছে সকল ধরনের নৌযান। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবী স্থানীয়দের সাথে সমন্বয় করে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ নদীতে ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করলে দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হবে।
নৌপথে যাতায়াতকারী ও নৌযান চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ হাতিয়ার মেঘনা নদীর বিভিন্ন এলাকায় ড্রেজিং করে। কিন্তু তারা কারো সাথে কোন প্রকার সমন্বয় না করে নিজেদের মত কাজ শেষ করে চলে যায়। কয়েকদিন নৌযান চলাচলে সমস্যা না হলেও মাত্র এক মাসের মাথায় আবারও নদীতে দেখা দেয় নাব্যতার সংকট, সৃষ্টি হয় ডুবোচরের। আর এ ডুবোচরের কারণে বেশি বিপদে পড়তে হচ্ছে ঢাকা-হাতিয়া রুটে চলাচলকারী যাত্রীদের।
গত ৬-৭ মাস ধরে প্রতিদিন ঢাকা থেকে হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা তিনতলা বিশিষ্ট বড় লঞ্চগুলো নদীতে নাব্যতা সংকটের কারণে ডুবোচরে আটকা পড়ছে। এছাড়াও এ ডুবোচরের কারণে ছোট লঞ্চ চলাচল প্রায়ই ব্যাহত হচ্ছে। নৌযানগুলো এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ যাত্রীরা।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৯৭ সালে এ দ্বীপের সাথে রাজধানী ঢাকার সরাসরি লঞ্চ সার্ভিস চালু করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রথম দিকে একটি প্রতিষ্ঠান দুটি লঞ্চ দিয়ে যাত্রীসেবা শুরু করেন। গত তিন বছরে এ রুটে আরও একটি প্রতিষ্ঠান তাদের লঞ্চ সার্ভিস চালু করেছেন। বর্তমানে প্রতিদিন হাতিয়ার তমরদ্দি ঘাট থেকে দুটি লঞ্চ (এম.ডি ফারহান ও এম.ডি তাসফির) দুপুর সাড়ে ১২টা ও ১টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়, আবার প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৫টা ও সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকার সদরঘাট থেকে অন্য দু'টি লঞ্চ হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। হাতিয়ার রুটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ঢাকা-হাতিয়া রুটটি। এ রুটে লঞ্চে প্রতিদিন সহস্রাধিক যাত্রী আসা-যাওয়া করেন। এছাড়া হাতিয়ায় উৎপাদিত মাছ, চাল, ডালসহ বিভিন্ন মালামাল এ রুটে আমদানি রপ্তানি করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, উপজেলার নলচিরা-চেয়ারম্যানঘাট রুটে অন্তত ৭-৮টি ডুবোচর রয়েছে। যার ফলে গত ৪-৫ বছরে এই রুটটির পরবির্তন হয়েছে দুই বার। বর্তমানে এ রুটে তেমন একটা সমস্যা না থাকলেও প্রায়সময় নদীতে জোয়ার না থাকলে ডুবোচরে আটকা পড়ে সব ধরনের নৌযান। বর্তমানে এ দ্বীপের যাত্রীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মনপুরা-তমরদ্দি রুটের ডালেরচর এলাকার কয়েকটি বড় ডুবোচর ও ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার পূর্ব পাশে, হাতিয়া উপজেলার তমরদ্দি ঘাটের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে বধনারচর এলাকার মেঘনা নদীতে থাকা একটি ডুবোচর। এই ডুবোচরের কারণে প্রতিনিয়ত লঞ্চসহ সকল ধরনের নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ৩-৪ ঘন্টাব্যাপী চরে নৌযান আটকা পড়ায় ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। অনেক সময় হাতিয়ার ব্যবসায়ীদের কাঁচামালবাহী নৌযানও চরে আটকা পড়ে। পরবর্তীতে জোয়ার আসলে নৌযান চলাচল স্বাভাবিক হলেও আটকা পড়া নৌযানে থাকা কাঁচামাল নষ্ট হয়ে ক্ষতির মুখে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা।
তমরদ্দি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী মো. ইব্রাহীম বলেন, ঢাকা থেকে তমরদ্দিঘাটে লঞ্চ আসা যাওয়া করায় এখানে (তমরদ্দি বাজার) বড় পাইকারি বাজারে পরিনত হয়েছে। বর্তমানে বাজারটিতে প্রায় অর্ধশতাধিক আড়ৎ রয়েছে। আর এই আড়ৎগুলো থেকে উপজেলার বিভিন্ন বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা মালামাল ক্রয় করেন। কিন্তু বর্তমানে নদীতে ডুবোচরের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে লঞ্চ ঘাটে না পৌঁছার কারণে ব্যবসায়ীরা সঠিক সময়ে মালামাল আনা নেওয়া করতে পারছেন না।
তিনি আরও বলেন, লঞ্চ চলাচলের এ রুটটিতে অসংখ্য ডুবোচর রয়েছে। নদীতে ভাটার সময় কোন কোন চর জেগে ওঠে, আবার জোয়ারে তা তলিয়ে যায়। আর এসব চরেই আটকা পড়ে লঞ্চগুলো। এ আটকা পড়ার কারণে রাতে লঞ্চগুলোতে বড় ধরনের দূর্ঘটনার আংশকা থাকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অতিদ্রæত নদীতে ড্রেজিং ব্যবস্থা করে নৌ চলাচল নিরাপদ করার দাবী করেন তিনি।
হাতিয়ার ব্যবসায়ী শামীমুজ্জামান বলেন, 'ব্যবসার কাজে ঢাকা-হাতিয়া রুট হয়ে সপ্তাহে অন্তত ১-২দিন লঞ্চযোগে ঢাকা যেতে হয়। মালামাল নিয়ে সন্ধ্যা ৬টা ঢাকার সদরঘাট থেকে রওনা দিলে ৬ ঘন্টায় তমরদ্দি এসে পৌঁছার কথা থাকলেও লঞ্চ কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের সুবিধার্থে ভোর ৬টার দিকে ঘাটে পৌঁছায়। কিন্তু এর মধ্যে রাতে ডুবোচরে লঞ্চ আটকে গেলে ঘাটে আসতে পরদিন বেলা ১১টা হয়ে যায়। এতে কাঁচা মালামাল নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। এদিকে লঞ্চ আটকা পড়া সময়ে দ্রুত ঘাটে পৌঁছতে অনেক যাত্রী ঝুঁকি নিয়ে ছোট ট্রলার যোগে ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা করেন'।
ঢাকা-তমরদ্দি রুটে চলাচলকারী লঞ্চ এম.ডি ফারহান-৩ এর ইন্সপেক্টর মো. জহিরুল ইসলাম জানান, 'আমাদের লঞ্চে যাত্রী ধারনক্ষমতা ৬৩৯ জন। যাত্রী নিয়ে লঞ্চ চলাচলের জন্য নদীতে যে পরিমাণ পানির গভীরতা থাকা প্রয়োজন তা বর্তমানে নেই। তারপরও জোয়ারের সাথে তাল মিলিয়ে নৌ চলাচল করছে। প্রায় সময় ডুবোচরে লঞ্চ আটকে যায়। আটকা পড়লে জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু জোয়ারের নির্দিষ্ট কোন সময় না থাকায় কখনো কখনো ৩-৪ ঘন্টাও অপেক্ষা করতে হয়ে। এতে যাত্রীরা যেমন ভোগান্তিতে পড়ছে তেমনি সিডিউল ঠিক না থাকায় দিন দিন যাত্রীও কমে যাচ্ছে। যার ফলে আমাদের প্রতিদিনই ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে'।
বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ দ্রুত ড্রেজিং এর ব্যবস্থা করে এ সমস্যার সমাধান করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এ বিষয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ড্রেজিং বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হাতিয়া অঞ্চলের ডুবোচরগুলো নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ একটি জরিপ করেছেন। এখানে ড্রেজিং করতে হলে সবচেয়ে বড় ইঞ্জিন ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু হাতিয়ার পাশ্ববর্তী সন্দ্বীপ চ্যানেলে ড্রেজিং করার সময় তাদের ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে যাওয়ায় তা এদিকে পাঠানো যাচ্ছে না।