সুয়েজের জলপথ বন্ধ থাকার দায় কার? কে দেবে ক্ষতিপূরণ?
টানা সাতদিন সুয়েজ খালে আটকে থাকার পর চলতে শুরু করেছে মালবাহী জাহাজ এভার গিভেন। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত জলপথ স্বাভাবিক হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন পণ্য সরবরাহকারীরা। তবে, আশঙ্কা করা হচ্ছে এভার গিভেনকে কেন্দ্র করে নতুন ভাবে আইনী ঝামেলা শুরু হতে চলেছে। জাহাজ উদ্ধারে ব্যয় হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থের ক্ষতিপূরণ কার উপর চাপতে চলেছে তা নিয়ে এক দীর্ঘকালীন দ্বন্দ্বে জড়াতে চলেছেন অংশীদাররা।
দুই লাখ ২০ হাজার টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ৪০০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজটি প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সুয়েজে জাহাজ চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল। এভার গিভেনের দুই পাশেই আটকা পড়েছিল বহু জাহাজ। পণ্য পরিবহনে এই অচলাবস্থার কারণে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে দৈনিক প্রায় সাত বিলিয়ন ইউরো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অন্যদিকে, সুয়েজ খালকে দৈনিক ১০ দশমিক ৯ মিলিয়ন ইউরোর অধিক ক্ষতিপূরণ গুণতে হয়। সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষের (এসসিএ) প্রধান ওসামা র্যাবি জানান, "আমরা রেকর্ড সময়ের মাঝে জাহাজকে পুনরায় ভাসাতে সক্ষম হয়েছি। পৃথিবীর অন্য কোথাও এই ঘটনা ঘটলে সমাধানে তিন মাসের মতো সময় লেগে যেত।"
কিন্তু জাহাজ উদ্ধারে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন পড়েছে তার দায়ভার এখন কে নেবে? এই প্রশ্নের জট খুলতে ইন্স্যুরেন্স কর্মকর্তা থেকে শুরু করে তদন্তকারীদের সম্ভবত কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। তদন্ত কর্মকর্তারা ইতোমধ্যেই জাহাজটি পরিদর্শন করেছেন। মঙ্গলবার নিকটবর্তী গ্রেট বিটার লেকেও তদন্ত করেছেন তারা। ঠিক কী কারণে জাহাজ আটকে গিয়েছিল এবং প্রকৃতপক্ষে ঘটনার দায় কার সেই অনুসন্ধানে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
এভার গিভেনের প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান বার্নহার্ড শাল্ট শিপম্যানেজমেন্ট (বিএসএম) জোরালো বাতাসের উপর বারবার দোষ চাপাচ্ছেন। প্রতিষ্ঠানটির বিবৃতি অনুযায়ী, "প্রাথমিক তদন্তে জাহাজ আটকে পড়ার পিছে কোনো মেকানিকাল কিংবা ইঞ্জিনের ত্রুটি পাওয়া যায়নি।" পর্যবেক্ষকরা ঘটনাটিকে 'সেইল এফেক্ট' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বড় কোনো জাহাজের উপর যখন উঁচু করে কনটেইনারের স্তুপ চাপানো হয়, তখন তার জোরালো হাওয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে বেশি।
তবে, অনেকেই দ্বিমত পোষণ করছেন। বহু প্রতিবেদনে এভার গ্রিনের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঘটনাকে দায়ী করা হয়েছে। প্রথমদিকে এসসিএ জানায়, ঝড়ো হাওয়ায় জাহাজটি হাল ধরতে ব্যর্থ হয়। তবে এসবিএ প্রধান র্যাবি পরবর্তীতে এক বক্তব্যে জানান, বিষয়টি 'টেকনিকাল বা মানবীয় ত্রুটি'ও হতে পারে।
এভার গিভেনের মালিকানার নিয়ন্ত্রণে আছে জাপানিজ প্রতিষ্ঠান শোয়েই কিসেন কাইশা। প্রতিষ্ঠানটি সুয়েজ খালে আটকে পড়া অন্যান্য জাহাজগুলোর 'সীমাহীন দুর্ভোগে'র জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছে।
সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটির ইন্সটিটিউট অব মেরিটাইম ল'র অধ্যাপক জেমস ডেভি জাহাজের আইনী মোকাদ্দমার পাঁচটি প্রধান দিক চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হল- জাহাজের ক্ষতি, জাহাজে থাকা কারগো পণ্যের ক্ষতি, জাহাজ উদ্ধার প্রক্রিয়ার ব্যয়ভার, এসসিএর আর্থিক লোকসানসহ সুয়েজ খালের ক্ষতি এবং পরিবহনকালে বিলম্বের সৃষ্টি হওয়ায় আটকে পড়া জাহাজগুলোর ক্ষয়ক্ষতি।
তিনি জানান, "জাহাজকে পুনরায় ভাসানো এবং উদ্ধার কাজে ব্যবহৃত অর্থের পরিমাণ বিশাল।" বিশাল এই অর্থ সম্ভবত জাহাজ এবং কারগোর ইন্স্যুরেন্সকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভাগাভাগি করে নিবে। অন্যদিকে, জাহাজ উদ্ধারের সময় খালের যে ক্ষতিসাধন হয়েছে সেই অর্থের যোগান কে দিবে, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। "যেহেতু এখানে লাখ লাখ পাউন্ড অর্থ জড়িয়ে আছে, স্বাভাবিকভাবেই সমাধানে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে," বলেন তিনি।
আইনী প্রতিষ্ঠান ক্লাইড এন্ড কোং- এর হিসাব অনুসারে, এভার গিভেনের মূল্য ১১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি হতে পারে। অন্যদিকে, কারগোগুলোর জন্য অতিরিক্ত ৫০০ মিলিয়ন ডলার গুণতে হতে পারে। ইতিপূর্বে অন্য কোনো মালবাহী জাহাজের ক্ষেত্রে এত বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূ্রণের প্রয়োজন পড়েনি।
বেইরুতে লয়েড'স অ্যাজেন্সির সাবেক প্রধান মেরিনার ক্যাপ্টেন জামিল সায়েগ বলেন, এভার গিভেনের ক্যাপটেনকে সম্ভবত কোনো অপরাধের দায় নিতে হবে না। তবে ক্যাপ্টেনের অবহেলার বিষয়টি প্রমাণিত হলে তাকে দায়ী করা হতে পারে। তিনি আরও জানান, জাহাজটির সামনে এখন জটিল এক আইনী লড়াই অপেক্ষা করছে। ফিচ রেটিংস বিষয়টিকে "রিইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপুল ক্ষতির ঘটনা" বলে উল্লেখ করেছে।
তবে, তৃতীয় পক্ষের ক্ষতিপূরণের অধিকাংশ দাবি-দাওয়াই এভার গিভেনের ইন্স্যুরেন্সকারী প্রতিষ্ঠান ইউকে প্রটেকশন অ্যান্ড ইন্ডেমনিটি ক্লাবের উপর চাপতে চলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠানটি জানায়, "সকল যুক্তিসংগত দাবিগুলো যথাসময়ে জাহাজের মালিক, ইউকে ক্লাব এবং আইনী পরামর্শকদের উদ্যোগে বিবেচিত হবে।
তবে, সর্বশেষ ফলাফল সম্ভবত কয়েক বছরের আইনী মোকাদ্দমা এবং বিলিয়ন ডলারের এক বিশাল ইস্যুতে পরিণত হবে। "প্রতিষ্ঠানটিকে আগামী কয়েক বছর ব্যস্ত সময় পার করতে হবে, মেরিন আইনজীবীরাও সহজে স্বস্তি পাবেন না," জানান সায়েগ।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান