‘মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ এড়াতে এশীয় দেশগুলোকেই সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে’
মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের ঘটনায় আন্তর্জাতিক বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিচ্ছে পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ। যদিও, তাদের হুমকি-ধামকি বা নিষেধাজ্ঞা থেকে সুরক্ষিত দেশটির জেনারেলরা। পারতপক্ষে, তারা এসব পদক্ষেপ গ্রাহ্যই করে না। সে তুলনায় মিয়ানমারের ওপর অনেক বেশি প্রভাব আছে দেশটির এশীয় প্রতিবেশীদের, যারা সেখানে মূল বিনিয়োগকারী, দাতা এবং বাণিজ্য ও সামরিক সহযোগী। মিয়ানমারকে আরও বড় ধরনের নৈরাজ্যে থেকে বাঁচাতে এসব দেশকেই তাদের প্রভাব কাজে লাগাতে হবে।
অং সান সু চি'র নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির বেসামরিক সরকারকে দুই মাস আগে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে সামরিক নেতৃত্ব। তারপর থেকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল মিয়ানমার। ধর্মঘটে ব্যাহত হয়েছে দেশটির সরকারি সেবা ও অর্থনীতির কার্যক্রম। বন্ধ আছে অধিকাংশ ব্যাংক। পরিবহন ও পণ্য জাহাজীকরণও প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, বিক্ষোভকারী থেকে শুরু করে নিরীহ পথচারী যে কারো ওপর নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে সেনারা, একটি হিসাব অনুসারে তাতে এপর্যন্ত ৫৫০ জন মারা পড়েছেন। সংখ্যালঘু গোষ্ঠী অধ্যুষিত সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে তীব্রতা লাভ করেছে বিদ্রোহী ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার লড়াই। সার্বিক অবস্থা দেখে "নজিরবিহীন মাত্রায় এক ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধের" হুঁশিয়ারি দিয়েছে জাতিসংঘ, যা বাস্তবে রূপ নিলে সিরিয়ার মতো ভেঙ্গে পড়বে দেশটি।
তবে মোদ্দা কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের সীমিত মাত্রার নিষেধাজ্ঞার মুখে মিয়ানমারের জেনারেলরা ভয়ে গুটিয়ে যাবেন- এমন সম্ভবনা একেবারেই নেই। তার চেয়েও বড় কথা এশীয় দেশগুলো, জান্তা নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলে এবং ঐতিহাসিকভাবেই তারা একে-অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি। মিয়ানমার নিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ান একটি জরুরী সম্মেলন ডাকলেও- জোটটি সেখানে জান্তার বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টিতে সদিচ্ছা দেখাবে বলে মনে হয় না।
অথচ, তাদের সেটা করা উচিৎ। মনে রাখা উচিৎ, মিয়ানমারের অপেক্ষাকৃত তরুণ জনগোষ্ঠী এক দশকের সীমিত গণতন্ত্রের স্বাধীনতা পেয়েছে। তাই তারা জান্তার পুনরায় শাসনের প্রয়াস কোনোমতেই মেনে নিতে চাইবে না। এই অবস্থায় অনিশ্চয়তা ও নৈরাজ্যই একমাত্র নিশ্চিত পরিণতি। মিয়ানমারের প্রতিবেশীদেরাও এর পরিণাম থেকে রক্ষা পাবে না। আর গৃহযুদ্ধ যদি বেধেই যায় তাহলে তাদের সীমান্তের দিকেও শরণার্থীর ঢল নামবে।
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে মাদক ও প্রাকৃতিক সম্পদ পাচারের অবৈধ বাণিজ্যের মাধ্যমে আয় করার চেষ্টা বাড়াবে জান্তা। এই অবস্থায় থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশের কোম্পানির ব্যবসায়িক কার্যক্রম ব্যাহত হবে, তাদের ওপর জান্তা নিয়ন্ত্রিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য চাপের মাত্রাও বাড়বে। এরপরও, যারা ব্যবসা অব্যাহত রাখবে তাদের প্রচণ্ড জনরোষের মুখে পড়তে হবে। যেমন; সাম্প্রতিক বিক্ষোভের মধ্যেই জান্তার প্রতি চীনের সমর্থনের কারণে চীনা মালিকানার একাধিক কারখানায় জনতা আগুন ধরিয়ে দেয়। অর্থাৎ, গণতন্ত্রের বিপক্ষে গিয়ে ব্যবসা অনুকূল পরিবেশ আশা করা দুরাশায় রূপ নেবে।
জান্তার সঙ্গে একই সমান্তরালে যোগাযোগ ও চাপ প্রয়োগে অব্যাহত রাখতে হবে আসিয়ানকে। একাজে তারা পশ্চিমা দেশগুলোকে পাশে পাবে। আসিয়ানের বর্তমান সভাপতি ব্রুনেই মিয়ানমারের জন্য একজন বিশেষ দূত নিয়োগ বা একটি বিশেষ কন্টাক্ট গ্রুপ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে পারে, যেখানে সমন্বয় করবে জাতিসংঘসহ জাপান, ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তিসমূহ।
আর যেসব দেশ এখনও কোনো বিরূপ পদক্ষেপ নেয়নি, তাদেরকেও জান্তা ও সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ব্যবসার ওপর সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। বন্ধ করতে হবে অস্ত্র সরবরাহ ও সামরিক প্রশিক্ষণ। এক কথায়, জান্তার মত বদলাতে কূটনীতিকদের রাখতে হবে অগ্রগণ্য ভূমিকা।
'নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের হত্যা সহ্য করা হবে না' জান্তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষাকারী আঞ্চলিক নেতাদের এমন কড়া হুঁশিয়ারি প্রকাশ্যে এবং গোপনে দিতে হবে। অন্যদিকে, মিয়ানমারের চলমান মানবিক সঙ্কট মোকাবিলায় সহায়তা দানে এগিয়ে আসতে হবে সম্পদশালী দেশগুলোকে।
কিছু ক্ষেত্রে ভূরাজনীতি এই সহায়তার বিরুদ্ধে যাবে না। ভারত ও জাপান একটু কঠোর হলে তারা চীনের কাছে মিয়ানমারকে একেবারে হারাবে না। কারণ, বৃহৎ প্রতিবেশী চীনের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই জান্তা নেতৃত্বের মধ্যে ভয় ও অবিশ্বাস কাজ করেছে। তাছাড়া, একটি ন্যায্য ও নির্বাচিত সরকারই চীনের স্বার্থ রক্ষার পক্ষে উপযুক্ত অংশীদার হবে। বেইজিং যত তাড়াতাড়ি এটা উপলদ্ধি করবে- ততোই নিজের ক্ষতি কমাতে পারবে।
আসিয়ানকে অবশ্যই কাটিয়ে উঠতে হবে এর ঐতিহ্যগত জড়তা- এবং সেটাও করতে হবে দ্রুতই, সর্ব-বিনাশী হিংসার আগুন দাবানলে রূপ নেওয়ার আগেই।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত