মিমের আবির্ভাব কোথা থেকে
১৯৮৬ সালে রিচার্ড ডাউকিন্স বলেন, জীবনের মূল ভিত্তি হলো 'তথ্য'। প্রখ্যাত এই বিবর্তনবাদ বিশেষজ্ঞের মতে, বিবর্তন হলো জীবকুল ও পরিবেশের মধ্যে ক্রমাগত তথ্যের আদান-প্রদান। ডাউকিন্স লিখেছেন, জীবনকে বুঝতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে ভাবতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তির সমুদ্রে আমরা আকণ্ঠ নিমজ্জিত। আইপড, প্লাজমা ডিসপ্লে, কম্পিউটারের মতো প্রযুক্তিপণ্য আমাদের নিত্য ব্যবহার্য। কিন্তু তথ্যের প্রভাব আমরা খুব কমই উপলব্ধি করতে পারি।
তথ্য তত্ত্বের উত্থান আমাদের জীবনকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে সাহায্য করেছে। বিজ্ঞানীরা জেনেটিক কোডের অর্থোদ্ধার করেছেন। জীবমণ্ডল নিয়ে কথা বলছেন।
ধরিত্রীর সব ধরনের জীবন নিয়ে গঠিত জীবমণ্ডল আজ তথ্যে টইটম্বুর। জীববিজ্ঞানীরা তথ্যবিজ্ঞানকে আরও নিবিড়ভাবে বোঝার প্রয়াস চালাচ্ছেন।
জেনেটিক তথ্য স্থানান্তরে বার্তাবাহক আরএনএ-র ভূমিকা নিয়ে কাজের জন্য ১৯৬৫ সালে পুরস্কার পেয়েছেন ফরাসি জীববিজ্ঞানী জ্যাক মনো। তার মতে, জীবমণ্ডল যেমন প্রাণহীন পদার্থের বিশ্বের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তেমনি জীবমণ্ডলের ওপরও আরেকটি 'বিমূর্ত পৃথিবী' দাঁড়িয়ে যায়। সেই পৃথিবীর বাসিন্দা? আইডিয়া—হরেক রকমের আইডিয়া।
তিনি লিখেছেন, 'আইডিয়াতেও জীবকুলের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে।প্রাণীদের মতো আইডিয়ারাও তাদের কাঠামোকে স্থায়িত্ব দিতে চায়, নিজেদের বংশবৃদ্ধি করতে চায়। ...এমনকি তারা বিবর্তিতও হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, আইডিয়াদের 'ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা' আছে। আছে সংক্রামক ক্ষমতা। কোনো ধর্মীয় ভাবাদর্শ যখন একটি জনগোষ্ঠীর ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করে তখনই আইডিয়ার সংক্রামক ক্ষমতা টের পাওয়া যায়।
আমেরিকান নিউরোফিজিওলজিস্ট রজার স্পেরিও বেশ কয়েক বছর আগে এই সুরেই এক ধারণার পেশ করেছিলেন। বলেছিলেন, আইডিয়ারাও নিউরনের মতোই 'বাস্তব'। তিনি বলেছেন: 'আইডিয়ারা নতুন নতুন ধারণা বিকশিত করতে সাহায্য করে। তারা পরস্পরের সাথে এবং একই মস্তিষ্কের অন্যান্য মানসিক শক্তির সাথে, পার্শ্ববর্তী মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ করে। এমনকি বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে বহু দূরের বিদেশি মস্তিষ্কের সাথেও যোগাযোগ স্থাপন করে।'
ডাউকিন্সের নীতি অনুসারে, সব জীবন সত্তাই প্রতিলিপিকারের (replicator) মাধ্যমে বিবর্তিত হয়। যেখানে জীবন, সেখানেই আছে প্রতিলিপিকার। এই প্রতিলিপিকার যে নিউক্লিয়িক এসিডেরই তৈরি হতে হবে, তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রতিলিপিকারগুলো সিলিকন-ভিত্তিক রসায়নেরও তৈরি হতে পারে। কিংবা তাতে রসায়নের ছোঁয়াও না থাকতে পারে।
রসায়নবিহীন প্রতিলিপিকার কেমন হবে? ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত 'দ্য সেলফিশ জিন' বইয়ে ডাউকিন্স লিখেছেন, 'আমার ধারণা, এ গ্রহে সম্প্রতি নতুন ধরনের প্রতিলিপিকারের আবির্ভাব হয়েছে। ...এটি এখনও শৈশবকাল পার করছে, এখনও আদিম স্যুপের মধ্যেই আছে, কিন্তু অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিবর্তিত হচ্ছে।'
এই আদিম 'স্যুপটি' হচ্ছে মানব সংস্কৃতি; বিবর্তনের বাহক হচ্ছে ভাষা, এবং বিবর্তনের ক্ষেত্রটি হচ্ছে মস্তিষ্ক।
ডাউকিন্স এই অশরীরী প্রতিলিপিকারের নাম দিয়েছেন মিম (meme)। মিম হচ্ছে একটি সংস্কৃতি বা আচরণবিধির একটি উপাদান একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে অনুকরণের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে ছড়িয়ে যাওয়া।
তিনি লিখেছেন, মিম অনেকটা অনুলিপির মাধ্যমে এক মস্তিষ্ক থেকে অন্য মস্তিষ্কের 'মিম পুল'-এ স্থানান্তরিত হয়। ব্রেইন টাইম বা ব্যান্ডউইথের জন্য এরা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা করে 'মনোযোগের' জন্য। নিচে কিছু উদাহরণ দেয়া হলো-
আইডিয়া
একটি আইডিয়া প্রথমবারের মতো বা বারবার আবির্ভূত হয়েটিকে যেতে পারে কিংবা সামান্য বুদ্বুদ তুলেই হারিয়ে যেতে পারে। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে, এই বিশ্বাসকে এখন মিমই বলা চলে। অন্যান্য মিমের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর এই মিমটি নিজের আসন পোক্ত করেছে।
বুলি
কখনও কখনও কিছু বুলি বা কথাও মিম হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকায় 'সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট' কথাটি মিম হয়ে ওঠে। এই মিম থেকে প্রতিলিপির মাধ্যমে আরও বহু মিম সৃষ্টি হয় ('সারভাইভাল অফ দ্য ফ্যাটেস্ট'; 'সারভাইভাল অফ দ্য সিকেস্ট'; 'সারভাইভাল অফ দ্য ফেইকেস্ট'; 'সারভাইভাল অফ দ্য টুইস্টেড')।
ছবি
আইজ্যাক নিউটন বেঁচে থাকতে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাতদের একজন হওয়া সত্ত্বেও কয়েকশোর বেশি মানুষ জানত না তিনি দেখতে কেমন। অথচ এখন একটি ছবি থেকে প্রতিলিপির মাধ্যমে সৃষ্ট অসংখ্য ছবির মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষ জানে কেমন দেখতে ছিলেন নিউটন। ছবির মিমের আরেকটি উদাহরণ হলো লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত ছবি 'মোনালিসা'।
মস্তিষ্ক থেকে সৃষ্টি হয়ে খবরের কাগজ, রুপালি পর্দা কিংবা অন্য যেকোনো জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে মিম। মিমকে একক সত্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, বিবেচনা করা হয় কিছু ক্ষমতা সংবলিত ইউনিট হিসেবে।
কোনো বস্তু মিম নয়। বস্তু হলো মিমের শরীরী প্রতীক, অর্থাৎ বাহন।
জীববিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অতীতে মিম স্থানান্তরিত হতো 'মুখের কথা'র মাধ্যমে। এবং সে সময় মিম ছিল অত্যন্ত ক্ষণজীবী।পরবর্তীতে শক্ত জিনিস, কাদামাটির ট্যাবলেট, গুহাচিত্র, কাগজ প্রভৃতির মাধ্যমে স্থানান্তরিত হতে থাকে। মিম স্থায়িত্ব পায় আমাদের কলম, প্রিন্টিং প্রেস এবং অপটিক্যাল ডিস্কের মাধ্যমে। ছড়িয়ে পড়ে ব্রডকাস্ট টাওয়ার ও ডিজিটাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। গল্প, বিভিন্ন রেসিপি, দক্ষতা, উপকথা, এমনকি ফ্যাশনও মিমে পরিণত হতে পারে। এসব মিমকে আমরা অনুকরণ করি। ডাউকিন্সের মতে, মিমগুলো নিজেরা নিজেদের অনুকরণ করে।
তিনি লিখেছেন, 'আমার বিশ্বাস, উপযুক্ত পরিবেশ পেলে প্রতিলিপিকারগুলো সিস্টেম বা মেশিন তৈরির জন্য আপনা আপনিই একত্রিত হয়।'এ কথার মানে এই নয় যে, মিমের জীবন আছে। কথাটার মানে হচ্ছে, মিমগুলো একটি সত্তা হিসেবে কাজ করে যা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে এগিয়ে যায়। দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট-এর মতে, 'মিম হচ্ছে ইনফরমেশন-প্যাকেট।'
জিনের মতো মিমেরও বিশ্বজুড়ে নানা রকমের প্রভাব রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে (আগুন জ্বালানো, পোশাক পরা)এই প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী। কিছু মিম আবার মানবজাতির জন্য অত্যন্ত উপকারী (যেমন, রান্না করার আগে হাত ধোয়া)। তবে মিমগত সাফল্য ও জিনগত সাফল্য এক জিনিস নয়। মিম অনেক সময় ভীষণ ক্ষতিকরও হতে পারে—যেমন:পেটেন্ট করা ওষুধ ও আধ্যাত্মিক সার্জারি, শয়তানবাদের চর্চা, কুসংস্কার, কম্পিউটার ভাইরাস, বর্ণবাদী মিথ প্রভৃতি।
ভাষার জন্মের আগেও সর্বত্র অবাধ যাতায়াত ছিল মিমের। স্রেফ মিমিক্রি (mimicry) বা মূকাভিনয়ই জ্ঞানের প্রতিলিপির জন্য যথেষ্ট। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তির-ধনুক বানানো বা আগুন জ্বালানো শেখার কথা। প্রাণীদের মধ্যে শিম্পাঞ্জি আর গরিলারা অনুকরণের মাধ্যমে শিখতে পারে। কিছু কিছু গানের পাখি অন্য পাখির কাছ থেকে শুনে গান শিখতে পারে। সম্প্রতি পক্ষীবিশারদরা অডিও শুনিয়েও পাখিকে গান শেখাতে পেরেছেন।তবে মানব-ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরে মিম আর ভাষা হাত ধরাধরি করেই হেঁটেছে। ভাষা হচ্ছে সংস্কৃতির প্রথম অনুঘটক। ভাষার কাজ স্রেফ অনুকরণ নয়—এটি এনকোডিংয়ের মাধ্যমে জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়।
মহামারিবিজ্ঞানের ব্যাপারে কেউ কিছু বোঝার আগেই এর ভাষার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। একটি নির্দিষ্ট আবেগ ক্ষতিকর হতে পারে, সুর চিত্তাকর্ষক হতে পারে, অভ্যাস হতে পারে সংক্রামক। এখনকার যুগ ভাইরালের যুগ: ভাইরাল শিক্ষা, ভাইরাল মার্কেটিং, ভাইরাল ই-মেইল, ভিডিও, নেটওয়ার্কিং। এই 'ভাইরাল' শব্দটি মহামারিবিজ্ঞান থেকে ধার করা। গবেষকরা যে ইন্টারনেটকে একটি মাধ্যম হিসেবে দেখেন, এতেও রয়েছে মহামারিবিজ্ঞানের ভাষার পাশাপাশি এই বিজ্ঞানের গাণিতিক নীতির প্রয়োগ।
'ভাইরাল টেক্সট' ও 'ভাইরাল সেন্টেন্সেস' শব্দবন্ধগুলো প্রথম ব্যবহার করেছিলেন রিচার্ড ডাউকিন্সের এক পাঠক, স্টিফেন ওয়ালটন, এবং কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট ডগলাস হফস্ট্যাডার—১৯৮১ সালে।
মানুষ এখন মিমের বাহক। তবে কেউই পুতুল হতে পছন্দ করে না। পছন্দ করে না মিমের হাতে নিজের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে। তবে আমাদের মনের নিয়ন্ত্রণ খুব কম সময়ই নিজেদের হাতে থাকে।
ইন্টারনেট আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে 'মিম' শব্দটি আরও সুপরিচিত হয়ে ওঠে। সর্বব্যাপী হয়ে ওঠে মিমের ব্যবহার। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার পর প্রথম যে মিমটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেটি হলো, 'জাম্পড দ্য শার্ক'। কথাটির মানে হলো, কোনো কাজে নতুনত্ব আনার জন্য নিম্ন মানের কষ্টকল্পিত জিনিসের আমদানি করা। ধারণা করা হয়, এই কথাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন শন জে. কনোলি নামের এক কলেজছাত্র, ১৯৮৫ সালে। ১৯৯৭ সালে কনোলির রুমমেট জন হেইন jumptheshark.com নামের ডোমেইন নামের রেজিস্টার করেন এবং ওয়েবসাইটটির প্রচার শুরু করেন। কদিন পরই সাইটটিতে একটি প্রশ্ন আসতে থাকে ঘুরে-ফিরে:
প্রশ্ন: 'জাম্প দ্য শার্ক' কথাটার জন্ম কি এই ওয়েবসাইট থেকে, নাকি এই কথার জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে আপনি এই সাইট বানিয়েছেন?
উত্তর: এই সাইট ১৯৯৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর 'জাম্প দ্য শার্ক' কথাটির জন্ম দিয়েছে। সাইটটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে কথাটিও আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কাজেই এই সাইটই হচ্ছে মুরগি, ডিম, এবং এখন ক্যাচ-২২।
পরের বছর কথাটি প্রচলিত মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ২০০২ সালে 'নিউ ইয়র্ক টাইমস'-এর কলাম লেখক উইলিয়াম স্যাফায়ার 'জাম্প দ্য শার্ক'কে বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথা হিসেবে অভিহিত করেন। এর পরই লোকে নিজেদের অজান্তেই কথাবার্তা, লেখায় কথাটি ব্যবহার করতে আরম্ভ করে। যেকোনো ভালো মিমের মতো এর অনুকরণেও অনেকগুলো মিম সৃষ্টি হয়। ২০০৯ সালে উইকিপিডিয়ায় 'জাম্পিং দ্য শার্ক' কথাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মিম কি বিজ্ঞান? ১৯৮৩ সালে এক প্রবন্ধে হফস্ট্যাডার 'মিমেটিকস' শব্দটি ব্যবহার করেন। মিমেটিকস হচ্ছে মিম সংক্রান্ত পড়াশোনা।
বায়োইনফরম্যাটিকসে চেইন চিঠি নিয়ে গবেষণা করা হয়। চেইন চিঠিও মিম। চেইন চিঠি হলো, একাধিক প্রাপকের কাছে একই বার্তা সংবলিত পাঠানো চিঠি। এদেরও বিবর্তনমূলক ইতিহাস আছে। চেইন চিঠির উদ্দেশ্যই হলো প্রতিলিপি করা। সমস্ত চেইন চিঠির বক্তব্য একটাই—আমাকে অনুকরণ করো। কার্বন কাগজের কল্যাণে উনিশ শতকে চেইন চিঠি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে চেইন চিঠির জায়গা দখল করে দুটি প্রযুক্তি—ফটোকপি এবং ই-মেইল। ফটোকপি যুগের ৩৩টি চেইন চিঠি সংগ্রহ করে সেগুলোর ওপর গবেষণা করেন চার্লস এইচ. বেনেট। সবগুলো একই চিঠির অনুলিপি ছিল। গবেষণায় বেনেট দেখতে পান, সবগুলো কপিতেই কিছু বানান ভুল এবং সামান্য বিকৃত শব্দ ও বাক্যাংশ আছে। এই অনুলিপিগুলোতে অক্ষরগুলো বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে।
রিচার্ড ডাউকিন্স কখনো কল্পনাও করতে পারেননি যে তার হাত ধরে মিমেটিকসের মতো একটি বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা হবে। ১৯৯৭ সালে পিয়ার-রিভিউ করা 'জার্নাল অফ মিমেটিকস' প্রকাশিত হয়, অনলাইনে। যদিও আট বছর পর জার্নালটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। এই বিজ্ঞান নিয়ে কিছু তর্ক-বিতর্ক থাকলেও মিমের অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মিমের বিবর্তনের গতিও প্রতিনিয়ত বাড়ছে।তবে চিকিৎসাক্ষেত্রে যেমন কিছু খারাপ ও হাতুড়ে চিকিৎসক আছে তেমনি মিম-জগতেও আছে কিছু খারাপ মিম।
মাঝে মাঝে কিছু বানোয়াট মিম ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেটে যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। যেমন, একবার ভুয়া মিম ছড়িয়ে পড়েছিল যে, বারাক ওবামা হাওয়াই-তে জন্মাননি। সাইবার দুনিয়ায় প্রতিটি নতুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই নতুন নতুন মিম তৈরির ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ২০১০ সালে ফেসবুকে একটি লেখা ছড়িয়ে পড়েছিল: 'Sometimes I Just Want to Copy Someone Else's Status, Word for Word, and See If They Notice.'
তারপর ২০১১ সালে এই লেখাটিই সামান্য পরিবর্তিত রূপে ছড়িয়ে পড়ে টুইটারে: 'One day I want to copy someone's Tweet word for word and see if they notice.'
সে সময় টুইটারের সবচেয়ে জনপ্রিয় হ্যাশট্যাগগুলোর একটি ছিল '#ভাইরাল'।
মিম হচ্ছে জ্ঞানের ধারক। ঔপন্যাসিক ডেভিড মিচেল বলেছেন, 'মানুষের পৃথিবী গড়ে উঠেছে গল্প দিয়ে, মানুষ দিয়ে নয়।' মার্গারেট অ্যাটউড লিখেছেন, জ্ঞান এক বিস্ময়কর জিনিস। যে জিনিসটার সম্পর্কে আমরা জানতাম না, সেটার অস্তিত্ব এক মুহূর্ত আগেও আমাদের কাছে ছিল না। যেই মুহূর্তে জিনিসটা সম্পর্কে জানতে পারলাম, তখনই সেটি মূর্তিমান হয়ে উঠল আমাদের কাছে। এ যেন মঞ্চে জাদুকরের দেখানো ভেল্কিবাজি। একটা জিনিস এক মুহূর্ত আগেও ছিল না, কিন্তু এখন এসে মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়েছে।
দার্শনিক ফ্রেড ড্রেটস্কে ১৯৮১ সালে লিখেছেন: 'শুরুতে কেবল তথ্য ছিল। শব্দ এসেছে অনেক পরে। তথ্যের শব্দতে পরিণত হওয়া সম্ভব হয়েছে জ্ঞানের বিবর্তনের কারণে। জীবমণ্ডলের মতো তথ্যমণ্ডলও আছে, যদিও তা আমরা দেখতে পাই না। পৃথিবীতে একমাত্র আমরাই জীবমণ্ডল ও তথ্যমণ্ডল—দুই দুনিয়াতেই একসাথে থাকতে পারি।
ব্যাপারটা অনেকটা এরকম—দীর্ঘদিন ধরে অদৃশ্য জগতের সঙ্গে বসবাস করতে করতে আমরা অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি-ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছি। অজস্র প্রজাতির তথ্য সম্পর্কে জানি আমরা। নানা মাধ্যমে এসব তথ্যকে আমরা সংরক্ষিত করে রাখি—কিন্তু এসবের মালিক হতে পারি না। কোনো বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল যখন আমাদের কানে অনুরণিত হতে থাকে, কিংবা কোনো খেয়ালি লোক চলতি ফ্যাশনের দুনিয়াকে উল্টেপাল্টে দেয়, তখন কে হয়ে ওঠে মনিব আর কে দাস? মানুষ নাকি মিম?