করোনা মোকাবেলায় আরব আমিরাতের ‘নায়ক’ যে বাংলাদেশি
দুবাই মিউনিসিপ্যালিটিতে ২০০৬ সাল থেকে কাজ করছেন প্রবাসী বাংলাদেশি মোশাররফ হোসেন। গত বছরের নভেম্বরে মোশাররফের কাছে একটি ফোনকল আসে। জানানো হয়, কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে 'অসামান্য' ভূমিকা পালনের জন্য 'সম্মুখসারির যোদ্ধা' হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাত তাকেসহ আটজনকে সম্মাননা প্রদান করবে।
অবশ্য মোশাররফ বিষয়টি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাননি।
তবে তার জন্য অন্য এক চমক অপেক্ষা করছিল। গত ১৬ এপ্রিল তিনি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন বুর্জ খলিফায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। মোশাররফ হোসেন জানান, ৮২৮ মিটার উচ্চতার বুর্জ খলিফার আলোয় নিজের মুখচ্ছবি দেখতে পেয়ে গর্বে তার বুক ভরে যায়।
৩৮ বছর বয়সী এই প্রবাসী আরব নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'সেই সময়, আমি বুঝতে পারিনি বিষয়টি আসলে কী এবং আমার জীবনকে তা কীভাবে প্রভাবিত করতে চলেছে।'
'এখন আমাকে বহু মানুষ চেনে। সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি লাভের পর আমি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বন্ধুবান্ধর ও স্বজনদের ফোন পাচ্ছি। এটা আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি,' বলেন তিনি।
তিনি ২০০৬ সাল থেকে দুবাই মিউনিসিপ্যালিটিতে কাজ করছেন। ২০২০ সালে 'মহামারির বিরুদ্ধে উপসাগরীয় দেশের লড়াইয়ে ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার' করা স্বেচ্ছাসেবক ও পেশাজীবীদের স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে আরব আমিরাতের সরকারের পক্ষ থেকে মোশাররফসহ সাতজনকে 'সম্মুখসারির নায়ক' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
মিউজিক সহকারে বুর্জ খলিফায় চার মিনিট দৈর্ঘ্যের ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। 'আওয়ার ইউএই হিরোজ' শিরোনামে আটকর্মীর গল্প বলা হয় ভিডিওটিতে।
ভিডিও বার্তায় একটি কণ্ঠ বলতে থাকে, 'ভ্যাকসিন গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের নায়কদের প্রতি সমর্থন প্রদর্শন করুন। যখন তাদেরকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, তখন এই সম্মুখসারির নায়কেরা আমাদের খেয়াল রেখেছেন। এখন সাহায্যের প্রতিদান দেবার পালা আমাদের।'
মোশাররফ দুবাই মিউনিসিপ্যালিটির পোকামাকড় নিধনকারী বা পেস্ট কন্ট্রোল বিভাগে কাজ করতেন। গত বছর মার্চে আরব আমিরাতের জাতীয় নির্বীজকরণ প্রকল্পের জন্য তাকে বাছাই করা হয়। তিনি জানান, মহামারির শুরুতে পিপিই পরিধান এবং বিভিন্ন এলাকায় জীবাণুনাশক রাসায়নিক পদার্থ ছড়ানোর বিষয়ে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
মাঝে মধ্যে, সহজে পৌঁছানো সম্ভব নয়- এমন সব জায়গায় তিনি ড্রোনের মাধ্যমে জীবাণুনাশক ছড়াতেন।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সংযুক্ত আরব আমিরাত রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করে। এ সময় জনসাধারণকে ঘরে অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে রাস্তাঘাট, পার্ক, গণপরিবহন পরিষ্কার ও জীবাণুনাশক ব্যবহারের জন্য রাত ৮টা থেকে শুরু করে ভোর ৬টা পর্যন্ত কাজ করতেন মিউনিসিপ্যালিটির পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা।
মোশাররফ জানান, সংক্রমণের শুরুর দিনগুলোতে সর্বত্র অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল। 'কাল কী হবে, আগামীকাল আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে,' এ বিষয়ে ছিল না কোনো নিশ্চয়তা।
তবে অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও মোশাররফ ও তার দল থেমে ছিল না।
'আমরা সবসময় তিন, পাঁচ কিংবা সাতজনের দল হিসেবে কাজ করতাম। তারা আমাকে ভাবতে শিখিয়েছেন, বাকিরা যদি পারে, তবে আমিও পারব,' বলেন মোশাররফ। সবসময় একটি কথা তিনি মাথায় রাখতেন: 'মানুষকে বাঁচানো আমার পরম দায়িত্ব। এই দায়িত্ববোধ আমাকে রোজ সকালে কাজে যেতে অনুপ্রাণিত করত।'
এখন যদি পিছনে ফিরে আবারও একই কাজ করতে হয়? এই প্রশ্নের জবাবে মোশাররফ বলেন, 'অবশ্যই করব। দিন-রাত মিলিয়ে আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে হতো। আমাদের কাজের জন্য কোনো নির্ধারিত সময় ছিল না। কিন্তু সবই ছিল মানবতার খাতিরে। আমি আবারও একই কাজ করতে পারব।'
আরব আমিরাতে প্রথমবার আসার কথা স্মরণ করে তিনি জানান, বিদেশের মাটিতে একদিন নায়কের খেতাব পাবেন- এমনটা কখনোই ভাবেননি।
'আমি সবসময় স্কুল শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম,' বলেন তিনি।
হাজার হাজার বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকের মতো ২০০৩ সালে মোশাররফ পরিবারকে একটি স্বচ্ছল জীবন দেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আমিরাতে পাড়ি জমান।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আরব আমিরাতে ১০ লাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক বসবাস করছেন।
এই স্বীকৃতি মোশাররফকে জীবনের 'বৃহৎ চ্যালেঞ্জ'গুলো হাতে তুলে নিয়ে আরও 'দায়িত্ববান' হতে শিখালেও তা সম্ভব হয়েছে তার ব্যক্তিগত আত্মত্যাগের বিনিময়ে।
গত শুক্রবার পরিবারের সঙ্গে এক ভিডিওকলে তিন সন্তানের পিতা মোশাররফ তার সবচেয়ে ছোট মেয়ের প্রথম জন্মদিন উদযাপন করেন।
ছোট মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহার জন্মের পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে মোশাররফ এখনো সামনা-সামনি ওর মুখ দেখতে পারেননি।
'মেয়ের কথা খুব মনে পড়ে। ওকে কোলে তুলে নেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। মহামারির প্রকোপ কমলেই আমি বাচ্চাদের দেখতে বাড়িতে ছুটে যাব,' বলেন মোশাররফ।
মোশাররফের বাড়ি চাঁদপুর। ঢাকা থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে তার পরিবার ও পাড়া-প্রতিবেশী তাকে সাদরে গ্রহণ করতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
বাড়ির ছেলের এই সাফল্যে মোশাররফের পরিবারে নেমে এসেছে বাধহীন আনন্দের জোয়ার।
তার বাবা ৮০ বছর বয়সী শহীদ উল্লাহ আরব নিউজকে জানান, 'ছেলের জন্য আমরা সবাই গর্ববোধ করছি। এখন প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা হলে, তারা বিদেশে ছেলের ভালো কাজের প্রশংসা করে। আমার তাতে ভীষণ আনন্দ হয়।'
আরব আমিরাতের সম্মাননা লাভের পর ছেলের সঙ্গে কথা বলেন এই বাবা। তিনি ছেলেকে আশ্রয়দাতা দেশের সেবা করার জন্য অনুপ্রেরণা যোগান।
'তোমার প্রয়োজন আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এই মুহূর্তে আরব আমিরাতের মানুষও তোমার সেবার জন্য অপেক্ষা করছে। আর তাই আশেপাশের মানুষকে সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতা করবে,' বলেন তিনি।
-
আরব নিউজ থেকে অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা