ইটভাটায় কাজ করে ঢাবিতে ভর্তির সুযোগ, পূরণ হবে কী কাজলের স্বপ্ন
ইটভাটায় প্রতিদিন ২০০ টাকা মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন কাজল। কাদামাটির স্তুপ থেকে মাটি কেটে সেগুলো ভাটায় সরবরাহ করতে হয় তাকে। স্থানীয় হারদি মীর সামসুদ্দিন আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বন্ধ হয়ে যায় তার লেখাপড়া। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর পড়ার সময় কোথায়? ঘুম থেকে উঠেই কাজে যেতে হয় তাকে। স্কুলে যাবে কীভাবে?
ইটভাটার প্রচণ্ড গরম সঙ্গে রোদের তাপমাত্রা, এই দুই মিলে বিষিয়ে তোলে কাজলের মন। তার সামনে দিয়ে ইউনিফর্ম পরে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়া করে। কাজল চিন্তা করে, এভাবে চলতে পারে না। শুধু ইটভাটায় কাজ করে গেলে তার জীবনের কোনো মানে থাকবে না। তাকে লেখাপড়া করে বড় হতে হবে। সিদ্ধান্ত নেয় আবারও শুরু করবে লেখাপড়া। কিন্তু বাবা হারা সন্তানের জন্য দু’বেলা খাবার জোগাড় করাই যেখানে কঠিন, সেখানে লেখাপড়া করাতো আকাশ কুসুম চিন্তার মতো। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী গ্রামের গাংপাড়ার মৃত আয়ুব আলির ছেলে কাজল হোসেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে সবার ছোট।
কাজলের ওই দিন নেওয়া সিদ্ধান্ত তার জীবনকে বদলে দিয়েছে। ইটভাটায় কাজ করে সংসার চালানোর পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন লেখাপড়া। এইচএসসি পাস করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেয়েছে রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবে কাজল। তবে তার মনে এখন নতুন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার পর তার খরচ চালাবে কে? সংসার চালানো ও তার মাকে দেখবে কে? তাকে কী আবারও গ্রামে ফিরে গিয়ে ইটভাটায় কাজ করতে হবে?
২০০৫ সালে কাজলের বাবা যখন মারা যান তখন তার বয়স ৫ বছর। ২০০৬ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন কাজল। পরে ভর্তি হন হারদি মীর সামসুদ্দিন আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ২০১৩ সালে জেএসসি পাস করেন। নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর প্রাইভেট টিউটরের বেতন, যাতায়াত খরচ, পোষাক, বইপত্রসহ প্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা মায়ের পক্ষে মেটানো সম্ভব না হওয়ায় পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়।
সংসাসের হাল ধরতে গ্রামের একটি ইটভাটায় দৈনিক ২০০ টাকা মজুরিতে কাজ শুরু করেন। ভাটায় কাজ ছিল ইট কাটা মিস্ত্রীর সহকারী হিসেবে। ভাটা থেকে যে টাকা পেতেন তা মায়ের কাছে দিতেন। মা সংসার চালাতো আর বাকি টাকা জমিয়ে রাখতেন। বড় দুই ভাই পৃথকভাবে সংসার করতো। জমানো টাকা দিয়ে গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি কেনেন। কারণ ইটভাটার কাজ হয় বছরে মাত্র ৩-৪ মাস।
২০১৫ সালে আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করেন কাজল। পড়াশুনার পাশাপাশি ইটভাটায় চলে নিয়মিত কাজ। এসএসসি পরীক্ষার আগ মূহুর্তে প্রস্তুতির জন্য ভাটায় কাজ বন্ধ করে দেন। ২০১৭ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৮৯ পয়েন্ট পেয়ে তিনি এসএসসি পাশ করেন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরও ভাটায় কাজ করেছেন। কারণ কলেজে লেখাপড়ার খরচ বেশি। ২০১৯ সালে আলমডাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে তিনি এইচএসসি উত্তীর্ণ হন।
এইচএসসি পাসের পর জীবনে নেমে আসে আরও অন্ধকার। কারণ ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে কোচিং করতে হবে। যেখানে খরচ অনেক বেশি। কোচিং করতে মায়ের শেষ সম্বল একটি গরু ৪৪ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন।
গ্রামের বড় ভাই হাসান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে মায়ের ইচ্ছায় কোচিং করতে যান রাজশাহীতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সেখানে একটি কোচিংয়ে ভর্তি হন। থাকতেন বড় ভাইয়ের সঙ্গে রাবির হলে। এভাবে ৪ মাস রাজশাহীতে থেকে কোচিং করেন তিনি। গরু বিক্রির ৪৪ হাজার টাকার মধ্যে তার খরচ হয় ২৬ হাজার টাকা। ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের জন্য ফরম তোলেন বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
রাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় ‘এ’ ইউনিটে মেধা তালিকায় ৩৯ তম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বি’ ইউনিটে মেধা তালিকায় ৪৬৯তম স্থান অধিকার করেন। মেধা তালিকা অনুসারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেন কাজল। বুধবার (৪ ডিসেম্বর) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকা যাবেন কাজল। আর পড়ালেখার জন্য স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন বৃহস্পতিবার।
কাজল বলেন, ‘স্বপ্ন ছিল ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো। কিন্তু অর্থের অভাবে বন্ধ হতে পারে পড়ালেখা। কারণ ঢাকায় থাকলে কাজ করতে পারবো না। তাহলে আমার খরচ দেবে কে? ইটভাটায় কাজ করতে আবারও গ্রামে ফিরে আসতে হবে। থেমে যাবে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন। এছাড়া আমি ঢাকায় থাকলে মাকে দেখবে কে? ভোর ৫টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ভাটায় কাজ করলে এখন হাজিরা পাই ৩০০ টাকা। আগে দিতো ২০০ টাকা।’
কাজল হোসেনের মা মইফুল খাতুন বলেন, ‘কাজল ছোট থাকতে বাবা হারিয়েছে। কোনো দিন ভালো পোষাক, খাবার দিতে পারিনি তাকে। অনেক কষ্ট করে ভাটায় কাজ করে পড়াশোনা করেছে আর সংসার চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে অনেক টাকা লাগে, কোথায় পাব এতো টাকা? মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন বৃথা হতে চলেছে। গরিবের স্বপ্ন দেখাও ভুল।’
ইটভাটা মালিক আবু মুসা জানান, ‘কাজল পড়াশুনার পাশাপাশি আমার ইটভাটায় কাজ করে। সে খুব ভাল ছাত্র। কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। ভাটায় কাজ করে টাকা গুছিয়ে ভর্তি হতে ঢাকায় যাবে। কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে সে।’
কাজলের ইটভাটার সহকর্মী রহমত, নজরুল, হেকমত, লাকি খাতুন জানান, ইটভাটার কাজ শুরু হলে কাজল প্রতি বছর কাজ করে। ও অনেক কষ্ট করে আজ এতদূর আসতে পেরেছে। কাজলের মনের ইচ্ছা যেন পূরণ হয়। কাজে কখনও ফাঁকি দেয় না। ব্যবহারও খুব ভাল।
হারদি মীর সামসুদ্দিন আহমেদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘কাজল জেএসসি পাস করে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরা খোঁজ-খবর নিয়ে তাকে স্কুলে আসতে বলি। স্কুলের সবাই তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করেন। সে মেধাবী ছাত্র।’
আলমডাঙ্গা সরকারি ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গোলাম সরোয়ার মিঠু বলেন, ‘আমরা যতোটুক পেরেছি কাজলকে সহযোগিতা করেছি। মানবিক বিভাগের মেধাবী ছাত্র কাজল। সে অন্যদের কাছে মডেল। ওর বড় হওয়ার স্বপ্ন যেন পূরণ হয়।’