‘মানিকদার সঙ্গে এতগুলো ছবিতে কাজের সুযোগ পাওয়া আমার সৌভাগ্য’: শর্মিলা ঠাকুর
সত্যজিৎ রায় প্রতিষ্ঠিত মুখের পাশাপশি নতুন মুখ নিয়ে আসতেন ছবিতে। ছবির চরিত্র অনুযায়ী শিল্পীদের ভেঙে-গড়ে নিতেন। বিশ্ববরেণ্য এই পরিচালকের সঙ্গে পাঁচটি ছবিতে কাজ করেছেন শর্মিলা ঠাকুর।
সেই স্মৃতিচারণা করেছেন তিনি:
"যখন সত্যজিৎ রায় 'অপুর সংসার'-এর কাস্টিং করছিল তখন আমি মাত্র ১৩ বছরের। আমার মনে আছে ওঁ আমার বাড়ি এসেছিল আমার সঙ্গে কথা বলতে। আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতে। ওঁর স্ত্রী বিজয়া আমাকে একটি শাড়ি পরিয়ে, চুলে খোঁপা বেধে, কপালে টিপ পরিয়ে দিয়েছিল। সেদিনের ছবিটা এখনও আমার কাছে আছে।
যখন আমরা একসঙ্গে কাজ করা শুরু করি, মানিকদা চাইতেন আমরা স্ক্রিপ্ট পড়ব, কিন্তু তা মুখস্থ করব না। সেটে কখনো সব অভিনেতাকে একসঙ্গে শট বোঝাতেন না, যদি না তা অনেকগুলো চরিত্রের শ্যুট একসঙ্গে হয়, 'অরণ্যের দিনরাত্রি'র মেমোরি গেমের মতো। না হলে, সরাসরি আমাদের কাছে আসতেন, একটু ঝুঁকে পড়ে মুখোমুখি কথা বলতেন। একটা একটা করে শট বুঝিয়ে দিতেন।
শ্যুটের সময় কিছু অভিনেতাকে নিজের মতো করে শট দেওয়ার অনুমতি দিতেন, কাউকে দিতেন না। যেমন রবি ঘোষের অনুমতি ছিল যখন যেটা মাথায় আসছে বলে দেওয়ার। 'অরণ্যের দিনরাত্রি'র একটা শটে আমি আর কাবেরী যখন একদল অপ্রস্তুত তরুণদের মুখোমুখি হই, যারা কুয়োর জলে স্নান করছে, তখন সাবান মাখা রবিদা বলেছিলেন, 'আমি ফ্রেঞ্চ রিভেরাতে আছি।' কিন্তু ওই লাইনটা স্ক্রিপ্টে ছিল না। আবার সৌমিত্রকে কিন্তু সেই অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমাকে সঞ্জীব কুমারও একবার বলেছিলেন, 'সতরঞ্জ কে খিলাড়ি'তে সইদ জাফরির কাছে সুযোগ ছিল ইমপ্রোভাইজ করার। কিন্তু সঞ্জীব কুমার যদি কনুইও একটু বেশি ওঠাতেন, রায় সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, তাঁর শেখানো মতোই অভিনয় করতে। অবশ্য প্রত্যেকটা শট শেষ হলে 'এক্সিলেন্ট' বলতে কখনোই ভুলতেন না! একটা আলাদা এনার্জি সেটে নিয়ে আসতেন। তুমি সবসময় বুঝতে পারবে ক্যামেরার পিছনে ওঁর উপস্থিতি। আর তুমি চোখ বন্ধ করে ওঁকে বিশ্বাসও করবে।
আমার সত্যজিৎ রায়ের সব থেকে প্রিয় ছবি 'দেবী'। সিনেমা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও মেয়েটির মুখ তোমায় তাড়া করে বেড়াবে। যদিও সে সময় আমার বয়স ছোট ছিল, কিন্তু বাংলায় বললে বেশ 'পাকা' ছিলাম। আমার মনে আছে 'দেবী'র সেটে মানিকদা কাউকে অনুমতি দিতেন না আমার সঙ্গে কথা বলতে। ওরকম ভারি মালা পরে, ধূপের সামনে দীর্ঘক্ষণ একভাবে বসে থাকতে হত সুব্রত দা-র সামনে, যা গোটা জিনিসটাকে অপার্থিব করে তুলেছিল। মনে আছে, সেটে একবার এক বয়স্ক ভদ্রলোক, মনে হয় কোনো জুনিয়র আর্টিস্ট আমার সামনে শুয়ে পড়ে আমায় প্রণাম করতে শুরু করে। যেন আমি সত্যিকারের দেবী!
আকিরা কুরোসাওয়া বা ইঙ্গমার বার্গম্যানের কাছে ছবি তৈরির কত বাজেট থাকত, ভাবুন তো। কিন্তু সত্যজিৎ রায় বাজেট ও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার মাঝেই গোটা বিশ্বে নিজের ছাপ ফেলেছিলেন। ওঁর সঙ্গে এতগুলো ছবিতে অভিনয় করতে মেরে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করি, যেগুলো এখন ক্লাসিক। মাণিকদাকে খুব মনে পড়ে।"