প্রধানমন্ত্রী মোদিকে বিশাল সতর্কবার্তা পাঠাল বাংলা
পশ্চিমবাংলায় বিধানসভা নির্বাচন এবার কোনো অংশেই ভারতের জাতীয় নির্বাচনের চাইতে কম উত্তেজনাপূর্ণ ছিল না। গত এক বছর ধরে মোদি-শাহ জুটি তাদের সমস্ত শক্তিকে যেন এই রাজ্য জয়ের লক্ষ্যে নিয়োজিত করেন। এনিয়ে তারা এত ব্যতিব্যস্ত ছিলেন যে, অনেকেই বলছেন, এবছর বাংলার মানুষ ভোট না দিলে কেন্দ্রীয় সরকার হয়তো কোভিড-১৯ মোকাবিলার ব্যাপারে আরেকটু মনোযোগ দিত। রাজ্যটি জয়ে নিজেদের রাজনৈতিক অক্সিজেনের সবটুকুই খরচ করে বিজেপি, এতকিছুর পর জয় ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত দরকারি।
কিন্তু, আদতে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি ২০১৯ সালের নির্বাচনে যে পরিমাণ ভোট পেয়েছিল এবার বিধানসভায় সেই একই অনুপাতে ভোট বৃদ্ধি করতে পারেনি।
সেই তুলনায় ২০১১ সালের নির্বাচনে নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি দেখায় তৃণমূল। দলটি ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সাথে জোট বেধে বাম দলগুলোর প্রতি বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পেরেছিল। রাজনীতিতে এমন প্রভাব দেখানোর ফলেই ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে অনেক আইনপ্রণেতা স্বপক্ষ ত্যাগ করে মমতামুখী হয়ে ওঠেন।
এবার বিজেপিও তেমন কিছু করে দেখাবে বলে বেশিরভাগ বিশ্লেষক অনুমান করেছিলেন। বিশেষত, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবাংলায় দলটির অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর তেমন ধারণা করা অন্যায্যও ছিল না।
ওই নির্বাচনেই নিজেদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি করে ফেলে বিজেপি। ফলে এবার যেভাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয় তাতে রাজনৈতিক পন্ডিতেরা অনুমান করতে থাকেন, বিধানসভা নির্বাচনে লোকসভার চাইতেও অনেকগুণ ভালো করবে বিজেপি। এই আভাসের আরও বড় কারণ, বিজেপির উত্থান হয়েছে বাম ও কংগ্রেসের প্রভাব হ্রাসের জেরে। সঙ্গে তারা দখল করে মমতার হিন্দু ভোটের একটি অংশও। ধারণা করা হচ্ছিল, বাম ও কংগ্রেস সমর্থক হিন্দুরা যেমন বিজেপিতে ভোট দেবে, ঠিক তেমনি করেই সংখ্যালঘুদের একটি ছোট অংশও মমতার পক্ষত্যাগ করবে।
সেই তুলনায় তৃণমূল আরও বেশি মুসলিম ভোট পাবে বলে আভাস দেওয়া হয়। সিএনডিএস- লোকনীতি জরিপে উঠে আসে, ২০১৯ সালে মমতাকেই ভোট দেন ৭০ শতাংশ মুসলমান। এবছর সেই হার ৮৫ শতাংশে উন্নীত হওয়ার ধারণা করেছিলেন তৃণমূল সমর্থকেরা। শুধু এই বৃদ্ধির জেরেই মমতার ভোটের পরিধি অতিরিক্ত ৪ শতাংশ বৃদ্ধির অনুমান করা হয়। কিন্তু, সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ভোট বিজেপি এবং সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভোট তৃণমুলের ঘরে ওঠার এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে কি প্রভাব পড়বে- সেই প্রশ্নই অধিকাংশ বিশ্লেষককে ভাবিয়ে তোলে।
কিন্তু, শেষপর্যন্ত বাংলার ভোটে আবারও জয় পেয়েছে তৃণমূল। আর প্রথম দফার ফলাফলেই জানা যায়, ২০১৯ সালের তুলনায় এবার বিজেপি কম ভোট পেয়েছে। অবশ্য, সেই তুলনায় তারা প্রায় ৮০টি আসনে এগিয়ে প্রধান বিরোধী দল হয়ে গেছে।
তারপরও বললে ভুল হবে না, পশ্চিমবাংলাকে আসলে মমতা জয় করেননি বরং বিজেপিই বাংলায় হেরেছে। নির্বাচনী প্রচারে বিপুল অর্থ লগ্নী, কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার শক্তি, মূলধারার গণমাধ্যমের অধিকাংশ স্বপক্ষে থাকা এবং সামাজিক মাধ্যমের উপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের পরও তারা হেরেই গেছে। পরাজিত হয়েছে নিজেদের ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির শক্তি ও সমর্থন নিয়েও। এমনকি দুই বছর আগের সফলতাকে দলটি আরও সামনে এগিয়ে নিতে পারেনি।
এ যেন ২০১২ সালে উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনেরই দৃশ্য। তার আগে ২০০৯ সালে ওই রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত আকারের বিশাল জয় পায় কংগ্রেস, যার কৃতিত্ব রাহুল গান্ধীকেই দেওয়া হয়। এরপর বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর আগে থেকেই তিনি রাজ্যজুড়ে সভা-সমাবেশ করেছেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন, উ. প্রদেশের মোট ৪০৩টি বিধানসভা আসনের মধ্যে কংগ্রেস অন্তত ১০০টির বেশি আসন দখল করবে। এমনকি রাজ্যের সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবেও কংগ্রেসের উত্থানের অনুমান করা হয়। কিন্তু, ২০১২ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল সর্বসাকুল্যে ২৮টি আসন, কারণ ওই সময় নাগাদ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের ইউপিএ জোট সরকার একেবারেই অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের নানা ব্যর্থতার প্রতিফলনই আসলে দেখা গেছে উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে।
পশ্চিমবাংলাতেও কি বিজেপির ভাগ্যে সেটাই ঘটেছে? কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় মোদি সরকারের চরম ব্যর্থতার ফলেই কি তারা বাংলায় একটি বড় অংশের ভোট হারালো?
অথচ বাংলায় জয় পেলে বিজেপি ও সংঘ পরিবার পেতো নতুন অস্ত্র। কোভিড নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর ভারতবাসীর আস্থা আছে- এই জয়কে সেভাবে উপস্থাপন করা হতো। অন্যদিকে, নিশ্চিত পরাজয়ের মাধ্যমে এখন কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচকদের দাবিই শক্তিশালী হলো, উজ্জীবিত হলো বিজেপি বিরোধীরাও। ফলে ভারতের ক্ষমতাসীনদের আরও অনেকেই এবার দলত্যাগ করতে পারেন বা বিজেপিকে দেওয়া তাদের সমর্থন প্রত্যাহারের কথাও ভাবা শুরু করবেন অনেকেই। মোদি মানেই অপরাজেয় কোনো শক্তি নয়, এবার ভারতের সকল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও সেই বার্তা পাবে।
- লেখক: আনিন্দ্য চক্রবর্তী এনডিটিভির হিন্দি শাখায় জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন, তিনি বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংবাদ মাধ্যমেও কাজ করেছেন।