খেলনা থেকে ইমিটেশন জুয়েলারি, যাতায়াত বিধিনিষেধে হতাশ চকবাজারের ব্যবসায়ীরা
রাজধানীর চকবাজারের পাইকারি বেচা-কেনায় এবার মন্দা। অন্তঃজেলা যাতায়াত বন্ধ থাকায় মফস্বলের খুচরা ব্যবসায়ীরা এবার ঢাকায় আসতে পারেননি। লকডাউনের মধ্যে শেষে দোকান-পাট খোলার অনুমতি মিললেও হতাশ ব্যবসায়ীরা।
চকের ব্যবসায়ীরা জানান, লকডাউনে দোকান-পাট খোলার অনুমতি মিললেও বন্ধ আন্তঃজেলা গণপরিবহন। দিন কয়েক আগে পর্যন্তও রাজধানীতে গণপরিবহন বন্ধ ছিল। এতে জেলা থেকে তো দূরের কথা, খোদ রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে যেসব ছোট ব্যবসায়ীরা আছেন, তারাও পণ্য কেনার জন্য চকবাজারে আসতে পারেননি।
চক সার্কুলার রোডের সারা এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটর ইমিটেশন ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের পণ্যগুলো অভিজাত শ্রেণির জন্য নয়। ঢাকার মধ্যে এসব পণ্য খুব বেশি চলেও না। এসব পণ্যের মূল ক্রেতা মফস্বলের খুচরা ব্যবসায়ীরা। তারা এবার ঢাকায় না আসতে পারায় ব্যবসা একেবারেই মন্দা। কুরিয়ারে কিছু কাস্টমারের পণ্য পাঠিয়েছি। তবে এসব ফেন্সি পণ্য ব্যবসায়ীরা দেখে-শুনে কিনতে পছন্দ করেন। কুরিয়ারে পণ্য নিতে ভরসা পান না।'
'সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমাদের ব্যবসার কী অবস্থা। গত দুই মাস ধরে ঘর ভাড়া দিতে পারি না। ঈদ বাজারের পরে যদি ঘর ভাড়া নিয়ে চিন্তা করতে হয়, তাইলে সারা বছর টিকে থাকব কীভাবে, সেটাই চিন্তা,' বলেন তিনি।
খুলনার ব্যবসায়ী সাজ্জাদুল ইসলাম চকবাজারের পণ্য নিয়ে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে ব্যবসা করেন। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডাডকে বলেন, 'চকের জিনিসগুলোর লোকাল মার্কেটে চাহিদা ভালো। কিন্তু এসব পণ্য কয়েক হাতবদল হয়ে এলে দাম বেড়ে যায়। এজন্য আমরা সরাসরি ঢাকা থেকে পণ্য এনে স্থানীয় বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করি। তাতে খুচরা বিক্রেতারা তুলনামূলক কম দামে পণ্যগুলো পান। এবার পরিবহন বন্ধ থাকায় ঢাকায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। কুরিয়ারে আনা যেত। তবে এসব পণ্য দেখে-শুনে আনতে হয়। না দেখে ভরসা করা যায় না।'
চকবাজারের উর্দু সড়ক, শাহি মসজিদ এলাকা, ওয়াটার ওয়ার্কস ও চক সার্কুলার সড়কের অধিকাংশ ব্যবসায়ীর অবস্থা এমন। বিভিন্ন দোকানে দু-চারজন করে ক্রেতা ইমিটেশন অলংকার, মেহেদি, চুড়ি, ব্যাগ, তালা-চাবি, টুথব্রাশ, সাবান, কটনবাড, ক্লিপসহ বিভিন্ন পণ্য কেনাকাটা করছেন।
তবে এবার এখানকার প্লাস্টিকের খেলনা, তির-ধনুক, পিস্তল, রাবারের ক্রিকেট বল, রঙিন চশমা, জুতা, ফিতা ও অন্যান্য ছোট প্লাস্টিক পণ্যের কেনাবেচা একেবারে নেই বললেই চলে। ব্যবসায়ীরা জানান, মূলত ঈদকেন্দ্রিক মেলা বা ভ্রাম্যমাণ বাজার না বসতে পারায় এসব পণ্যের ক্রেতা নেই।
বিভিন্ন দোকানে এমন সাতজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা প্রত্যেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকার খুচরা ব্যবসায়ী; তবে অধিকাংশ দোকানেই তেমন ক্রেতা দেখা এবার যায়নি।
রাজধানীর কেরানিগঞ্জ থেকে চকে পাইকারি পণ্য কিনতে এসেছিলেন আজিজ আহমেদ। তিনি বলেন, 'ঢাকার বাইরের গ্রামগুলোতে ঈদের আগে মেয়েদের সাজগোজের পণ্যের বেশ চাহিদা থাকে। সেজন্য প্রতিবার আমরা কয়েকজন মিলে এসে পাইকারি দামে এসব পণ্য কিনে নিয়ে যাই। আমার নিজের দোকান আছে, সেখানে বিক্রি করি। তাছাড়া আমার কাছ থেকে অনেক ব্যবসায়ীরাও কিনে নেন। তবে এবার পণ্যের চাহিদা অনেক কম। কেউ কিনতে চাইছেন না।'
এছাড়া পণ্য পরিবহনে খরচ বেশি হওয়ায় লাভ কম হবে বলে জানান তিনি।
সিলেটের ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমরা চকের রেগুলার ক্রেতা নই। তবে ঢাকায় গেলে মেলাকেন্দ্রিক জিনিস নিয়ে আসতাম। বিশেষ করে ঈদ-পূজার আগে পরে সিলেটে বেশকিছু বাজার বসে ওগুলোতে ভালো ব্যবসা হতো । এবার এমন উদ্যোগ নেই, তাই আমাদের ব্যবসা বন্ধ।'
চকবাজারের ব্যবসায়ীদের দাবি, ঈদের বাজার হিসেবে এই বেচাকনা একেবারেই কম। বরং ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তারা দোকান খোলা রেখেছেন। লকডাউনে পণ্যের চাহিদা কমায় দামও কম পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এই অবস্থায় স্টকের পণ্যগুলো খালাস করে গুদাম হালকা করার কথা বলছেন তারা।
ইয়াকুব মার্কেটের ইমরান স্টোরের পাইকারি খেলনা বিক্রেতা মহসিন আলী বলেন, 'বছরব্যাপী খেলনা বিক্রি তেমন হয় না। ঈদ, পূজা বা বৈশাখী মেলা উপলক্ষে খুচরা বিক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে পণ্যগুলো কম দামে নিতে পারেন। কিন্তু মেলা ও ভ্রাম্যমাণ বাজার এখন বন্ধ। এবার ঈদের বাজারও নেই বলতে গেলে। সবমিলিয়ে আমাদের বেচাকেনা পাঁচ ভাগের একভাগও নেই। বেচাকেনা থাকলে এমন সময় আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় পাওয়ার কথা না।'
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ব্যবসায়ী আরাফাত হোসেন বলেন, 'ঈদের আগে ঢাকায় গিয়ে আমার তিন দোকানের জন্য মালামাল কিনতাম। স্থানীয় বিক্রেতাদের কাছেও বিক্রি করতাম। এবার পণ্য আনতে না পারায় নিজের দোকানই খালি। এমনিতেই বেচাকেনা কম। তাতে মালামালও নাই।'
'ব্যবসা কেমন চলছে,' প্রশ্ন করলে চকবাজারের রুপসা সু স্টোরের স্বত্বাধিকারী নূর মোহাম্মাদ বলেন, 'এমনিতেই আমাদের বেচাকেনা ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান বা দিবসকেন্দ্রিক। ফলে বছরের নির্দিষ্ট কয়েক মাস ভালো বেচাকেনা হয়। বাকি সময় তেমন ব্যবসা হয় না।'
'এরমধ্যে এবারও গতবারের মতো হলো। বৈশাখ, ঈদ গেল। সামনে কুরবানি আর পূজা আছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। যে চালান আছে, তা নিয়ে অন্য ব্যবসা করলেই বরং দুই বেলা খাবার জোগাড় করা যাবে,' বলেন তিনি।
চকবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনলাইনে দেশের বাইরের পণ্যের কদর বেড়েছে। বড় বড় আমদানিকারক সেসব পণ্য খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। ঢাকার বাইরের অনেকেও বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করছেন। এতে দেশীয় বাজার সংকটের মুখে। চকবাজারে ক্রেতা আসছে কম।
বাংলাদেশ প্লাস্টিক ব্যবসায়ী সমিতির অফিস সম্পদক মোহাম্মাদ সেলিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডাডকে বলেন, 'চকবাজারের অধিকাংশ পণ্যই দামে সস্তা। এগুলো মূলত প্রস্তুত করা হয় দেশীয় বাজারের জন্য। সারা বছর ফেরি করে বিংবা স্থানীয় দোকানে বিক্রি হয়। তবে ঈদ-পূজাকে কেন্দ্র করে এই ব্যবসা সবসময় জমজমাট থাকে। এই সময় মেলার অস্থায়ী বাজারে এসব পণ্যের বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এবার পরিস্থিতির কারণে সেটা হয়নি। আমরা আমাদের তরফ থেকে ব্যবসায়ীদের বুঝানোর চেষ্টা করেছি। সরকারকেও এসব ছোট ব্যবসায়ীদের কথা মাথায় রাখতে হবে।'
'চকবাজারকে কেন্দ্র করে আশপাশে কয়েক হাজার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও কারখানা গড়ে উঠেছে, যারা এসব পণ্য সারা দেশে সাপ্লাই দেয়। এসব দিবসকে কেন্দ্র করে বছরের বড় একটা ব্যবসা হয়। কিন্তু অন্তঃজেলা যাতায়াত বন্ধ থাকায় ঢাকার বাইরের ব্যবসায়ীরা এবার ঢাকায় আসতে না পারায় ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারে নেই বললেই চলে। কুরিয়ারে খরচ অনেক বেশি। ব্যক্তিগত পরিবহনে আর কত ডেলিভারি দেওয়া যায়? সবমিলিয়ে এবার ছোট ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে', বলেন তিনি।