করোনার মাঝেও সচল দিনাজপুরের মধ্যপাড়া খনি, রেকর্ড পরিমাণ পাথর বিক্রি
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে যখন সবকিছুই প্রায় স্থবির তখনও সচল রয়েছে দিনাজপুর মধ্যপাড়া পাথর খনির কার্যক্রম। স্থবিরতার মধ্যেই এখানে গত এপ্রিল মাসে এক লাখ মে.টনের উপর পাথর বিক্রি হয়েছে। শুধু তাই নয়, তৃতীয়বারের মতই এই খনি থেকে লাভের আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের একমাত্র পাথর খনি দিনাজপুরের মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (এমজিএমসিএল) বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে ২০০৭ সালের ২৫ মে। প্রথম অবস্থায় খনি থেকে দৈনিক ১ হাজার ৫শ' থেকে ১ হাজার ৮শ' টন পাথর উত্তোলন হলেও পরে তা নেমে আসে মাত্র ৫শ' টনে। এমন অবস্থায় উৎপাদন বাড়াতে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৯২ লাখ মেট্রিক টন পাথর উত্তোলনের বিপরীতে ১৭১.৮৬ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে খনির উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় বেলারুশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম-জিটিসি'কে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৩ শিফটে পাথর উত্তোলন করছে প্রায় সাড়ে ৭ শত শ্রমিক। প্রতিদিন ৩ শিফটে এখানকার পাথর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৫৫০০ মে.টন। অবশ্য কখনো কখনো লক্ষ্যমাত্রারও বেশি পাথর উত্তোলন করে প্রতিষ্ঠানটি।
হিসেব বলছে- ২০১৪ সালে জিটিসি খনির দায়িত্ব নিয়েই তিন মাসের মধ্যেই ৩ শিফটে পাথর উত্তোলন শুরু করে এবং উত্তোলনের রেকর্ড তৈরী করে। যেখানে প্রতিদিন ৫শ' টনের মত পাথর উত্তোলন হতো সেখানে পাথর উত্তোলনের পরিমাণ বাড়ে দৈনিক ৪ হাজার মে.টনেরও বেশি। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বিপণনও বৃদ্ধি পায় পাথর খনিটির। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম অর্থবছর ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে খনিতে পাথর উত্তোলন হয় ৯ লাখ ৩১ হাজার ৪৭৬.২০ মে.টন পাথর। আর বিক্রি হয় ৫ লাখ ১৫ হাজার ৪৯৭.১৭ মে.টন পাথর। যার বিক্রয়মূল্য ৭৪ কোটি ৪৯ লাখ ১১ হাজার টাকা। এছাড়াও ২০১৫-২০১৬ অর্থ বছরে পাথর উত্তোলন হয় এক লাখ ৫৩ হাজার ৭১৯ মে.টন, আর পূর্বের মজুদসহ বিক্রি হয় ৬ লাখ ২৫ হাজার ৮৩১ মে.টন পাথর। যার বিক্রয়মূল্য ১০৫ কোটি ৬১ লাখ ৪৬ হাজার টাকা, ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে উত্তোলনে বিঘ্ন ঘটে। ওই অর্থ বছরে পাথর উত্তোলন হয় ৫৬ হাজার ৫১৮.২৯ মে.টন পাথর আর পূর্বের মজুদসহ বিক্রি হয় এক লাখ ৮২ হাজার ৯৮ মে.টন পাথর, যার বিক্রয়মূল্য ২১ কোটি ১৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ মেরামত করে আবারও উত্তোলনের রেডর্ক তৈরী হয় এখানে। ওই অর্থ বছরে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩৩.২২ মে.টন পাথর উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে বিক্রি হয় ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৮৮.৫৬ মে.টন পাথর যার বিক্রয় মূল্য ১৪৭ কোটি ৮৮ লাখ ৩১ হাজার টাকা। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে সরকারী কোষাগারে জমা দিয়েছে ২৭ কোটি ৭৪ লাখ ৪৬ হাজার টাকা টাকা।
খনি সূত্রে জানা যায়, উৎপাদন শুরু হওয়ার সময় থেকে খনিটি প্রথম লাভের মুখ দেখতে পায় ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে। এই অর্থবছরে খনিটির নীট মুনাফা অর্জিত হয় ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। আর রাজস্ব খাতে জমা হয় ৩৩ কোটি ২ লাখ টাকা। হিসেব বলছে-২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৬৪৬.৬৩ মে.টন পাথর উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে বিক্রয় হয় ৭ লাখ ৩১ হাজার ৪৯৩.৫৬ মে.টন যার বিক্রয়মূল্য ১৬৩ কোটি ১৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। ওই অর্থ বছরে খনিটি সরকারী কোষাগারে জমা দিয়েছে ৩৩ কোটি ২ লাখ ৭৬ হাজার টাকা টাকা। এছাড়াও নীট মুনাফা অর্জন করেছে ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এটিই প্রথমবারের মত মধ্যপাড়া পাথর খনির লাভ।
এছাড়াও গত ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সাড়ে ৪ মাস বন্ধ থাকা সত্বেও পাথর উত্তোলিত হয়েছে ৮ লাখ ২৩ হাজার ৯৫৯.১০ মে.টন। পূর্বের মজুদসহ এই অর্থ বছরে বিক্রয় হয়েছে ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৯০৬.৫২ মে.টন যার বিক্রয়মূল্য ২০৭ কোটি ৮১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এই অর্থ বছরে সরকারী কোষাগারে জমা দেয়া হয় ২২ কোটি ৬ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। এছাড়াও নীট মুনাফা অর্জিত হয়েছে ২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে মানুষের জীবন-জীবিকা দিশেহারা হয়ে পড়লেও গত এপ্রিল মাসে ২০ কোটি টাকার উপরে রেকর্ড পরিমাণ পাথর বিক্রি হয়েছে। যদিও করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন শুরু হলেও খনি শ্রমিক এবং পাথর পরিবহনের সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত এলাকার তিন সহস্রাধিক মানুষ এবং ব্যবসায়ীগণ করোনার কারণে খনি বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেছিলেন। কর্মহীন হয়ে পড়ার শঙ্কায় ছিল শতাধিক শ্রমিক। কিন্তু পাথর উত্তোলন ও বিক্রি চালু স্বাভাবিক রাখায় সকল আশঙ্কা দূর হয়েছে তাদের। দেশের উন্নয়নে উন্নতমানের পাথর ব্যবহারের কথা ভেবে তিন শিফটে মধ্যপাড়া খনির পাথর উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জিটিসি। পাথর উত্তোলন অব্যাহত থাকায় পাথর বিক্রিও বেড়েছে।
তাই প্রতিদিন ভোর থেকে খনির মেইন গেটের সামনে প্রধান সড়কে শত শত ট্রাক পাথর নিতে লাইন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে। বর্তমানে প্রতিদিন বিক্রিত পাথর দুই শতাধিক ট্রাক খনি থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে পাথর বহন ও ক্রেতাদের পদচারণায় মুখরিত খনি এলাকা। এই খনিকে কেন্দ্র করে খনি এলাকায় গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকান।
খনি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিভিন্ন ইয়ার্ডে পাথর মজুদ রয়েছে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। জিটিসি কর্তৃক রেকর্ড পরিমাণ পাথর উত্তোলনে খনির বিভিন্ন ইয়ার্ডে মজুদ থেকে এপ্রিল মাসে পাথর বিক্রি আগের পাথর বিক্রির রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। পাথরের বিক্রি আশাতীত হওয়ায় চলতি অর্থ বছরেও (২০২০-২০২১) তৃতীয়বারের ন্যায় মধ্যপাড়া পাথর খনি লাভের মুখ দেখবে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আবারও গত দুই অর্থ-বছরের ন্যায় প্রফিট বোনাস পাবেন বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
মধ্যপাড়া পাথর খনিটিতে দেশি-বিদেশিসহ ২০০ কর্মকর্তা ও ৭৫০ জন শ্রমিক তিন শিফটে কাজ করছেন। করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল দিনাজপুরের মধ্যপাড়া পাথর খনির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জিটিসির প্রচেষ্টায় এবারও অর্জিত হয়েছে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা। প্রতিদিন যে ৫৫০০ মে.টন পাথর উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সেই পরিমাণে পাথর উত্তোলন করছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি এলাকায় সামাজিক বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমও চালাচ্ছেন জিটিসি।
মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (ইউজিওএন্ডএম) আবু তালেব ফরাজী বলেন, গত এপ্রিল মাসে পাথর বিক্রি হয়েছে এক লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি। যার আনুমানিক মূল্য ২০ কোটি টাকার উপরে। আর কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানায় করোনায় কোনো সমস্যা হয়নি এখানে। খনি থেকে গড়ে প্রতিদিন পাথর উত্তোলন হচ্ছে ৪ হাজার মেট্রিকটন এবং বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিকটন। এখন পর্যন্ত খনির বিভিন্ন ইয়ার্ডে মজুদ রয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন পাথর। গত দুইবছর থেকে খনিটি লাভজনক রয়েছে এবং অব্যাহত থাকবে আশা করেন তিনি।